সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম যথাযথ বাস্তবায়নের দাবীতে র্যালি ও ছাত্র সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।
সকাল ৯ ঘটিকার সময় ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরা মাতৃভাষায় শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন দাবী দাওয়া সম্বলিত প্লেকার্ড, পেস্টুন ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালা হাতে নিয়ে খাগড়াছড়ি সদরের মহাজন পাড়াস্থ সূর্যশিখা ক্লাব প্রাঙ্গন থেকে র্যালির মাধ্যমে সকল ভাষা শহীদদের স্মরণে খাগড়াছড়ি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে র্যালিটি খাগড়াছড়ি সদরস্থ খাগড়াপুরে এসে শেষ হয়।
এরপর খাগড়াপুরে এক ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩ উদযাপন কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী সুনেন্টু চাকমার সভাপতিত্বে পিসিপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী বিজয় চাকমার সঞ্চালনায়প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্রী সুধাকর ত্রিপুরা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সহ-সভাপতি ও সাবেক ছাত্র নেতা শ্রী প্রীতি খীসা; রাঙ্গামাটি জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্র নেতা শ্রী সুমেধ চাকমা; খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি ও সাবেক ছাত্র নেতা শ্রী প্রত্যয় চাকমা; মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রীমতি ববিতা চাকমা; যুব সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক ছাত্র নেতা শ্রী জ্ঞান প্রিয় চাকমা; সাবেক ছাত্র নেতা জগদীশ চাকমা, সাবেক ছাত্র নেতা শ্রী রাজ্যময় চাকমা প্রমূখ।
সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন উদযাপন কমিটির সংগ্রামী যুগ্ম আহ্বায়ক শ্রী সুনয় চাকমা, বক্তব্য প্রদানে করেন পিসিপি দীঘিনালা থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী রিংকু চাকমা, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী অরবিন চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী সুভাষ চাকমা।
বক্তরা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম আজো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কিছু বই বিতরণ করা হলেও চাহিদার তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য। তথাপিও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় মাতৃভাষায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে মাত্র তিনটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় সামান্য কিছু বই বিতরণ করা হয়েছে অপরদিকে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব যার ফলশ্রুতিতে স্ব-স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো শিক্ষা লাভ করতে পারছেনা।
বক্তারা বলেন একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাষা। কোন জাতিগোষ্ঠী যদি ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে তাহলে তারা এই পৃথিবীর বুক থেকে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর এই বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে তাদের ভাষাকে টিকিয়ে রাখার কোন বিকল্প নেই। মানুষ ঘুমানোর সময় নিজের মাতৃভাষাতেই স্বপ্ন দেখে, অন্যকোন ভাষায় স্বপ্ন দেখেনা। ৫২’র ছাত্র সমাজ যেভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন আত্মহুতি দিয়েছে প্রয়োজনে আমাদের তরুণ জুম্ম ছাত্র সমাজ তাদের মত বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে বলে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্ববান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। আজকে সাজেকে ভালো ভালো রাস্তাঘাট হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার রিসোর্ট হচ্ছে, প্রতিদিন শত শত লোক সমতল থেকে আসছে কিন্তু একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, একটি ভালো হাসপাতাল নেই, অর্থনৈতিক অবস্থা শোষণীয় পর্যায়ে। সাজেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবস্যা হচ্ছে বিনিময়ে স্থানীয় জুম্মরা নিজেদের ভূমি ছেড়ে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে দেশান্তরী হচ্ছে। আজকে নির্বাচনীহীন জেলা পরিষদে ঘুষ-দুর্নীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটি চাকরির পেছনে ১৫-২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যারা যোগ্য প্রার্থী টাকার কাছে তারা হেরে যাচ্ছে। বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে প্রান্তিক অঞ্চলে যেসব শিক্ষকরা চাকরি করেন তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস না করিয়ে ৯-১০ শ্রেণীতে পড়া লোকদের বর্গা দিয়ে স্কুল চালায়। ফলশ্রুতিতে প্রান্তিক এলাকার শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রী সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, যৌবন যার-যুদ্ধে যাবার সময় তার। আজকে ছাত্র-তরুণ সমাজের যৌবন আছে সুতরাং যুদ্ধে যাবার সময় এখনিই। আমরা তরুণ বয়সে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি। তার ফলস্বরুপ আমরা চুক্তি করেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আজ পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি আপনারা চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন এই প্রত্যাশা আপনাদের কাছে আমি রাখছি। চুক্তির ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির অন্যতম একটি ধারা হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা। জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের তাগিদে এই চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছে। সুতরাং মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের যে আন্দোলন তাতে ছাত্র-তরুণ সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত অপরিহার্য।
সমাবেশ থেকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কিছু দাবীনামা উপস্থাপন করে।
দাবীনামাগুলো হলঃ
১। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
২। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে।
৩। দেশের উচ্চমান সম্পন্ন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, কারিগরি, ক্যাডেট ও অন্যান্য কলেজ) আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য ৫% কোটা চালু ও ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি করতে হবে।
৪। অতিদ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।