সিএইচটি ভ্যানগার্ড

২০১১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিল পাসের আজ ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশে বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য জাতিসত্তাদের/আদিবাসীদের স্বীকার করেনি। আদিবাসীদের উপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিয়ে তাদের জাতীয় অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র এখনো চলমান রয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর ৬ অনুচ্ছেদের ১) এ বলা হয়েছে- “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে”।
এবং (২)- এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন”।
২৪ এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলেও তাদের দ্বারা রচিত বিতর্কিত সংবিধানের এই ধারাটি এখনো রয়ে গিয়েছে। ২৪ এর গণ অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার সকলের অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার কথা থাকলেও দেখা গিয়েছে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সভায় বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলই বহুত্ববাদকে স্বীকার করেনি। সকলেই বাংলাদেশকে শুধুমাত্র বাঙালিদের দেশ বলে বিশ্বমঞ্চে জাহির করতে চাইছে।
দেশের আদিবাসী জনগণ মনে করেছে এই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ যে সংস্কারের দিকে এগোচ্ছে, সংবিধান সংস্কার হচ্ছে- তাদের অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা হবে। তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হবে, কিন্তু এখনো চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারাটি এখনো রয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে তাতিন্দ্র লাল চাকমা, অংশুমান চাকমা সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামীলীগ নেত্রী ও সংবিধান সংশোধনী কমিটির প্রধান সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও সমতলের আদিবাসীদের সংবিধানে স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবী দাওয়া তারা লিখিতভাবে তুলে ধরেন। কিন্তু সংশোধনীর পর দেখা গেল জনসংহতি সমিতির দাবী দাওয়ার কোন কিছুই তারা রাখেন নি।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এমএন লারমাসহ তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪ দফা দাবীনামা পেশ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু উল্টো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ঢুকিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার হুমকি দেন।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সংসদে খসড়া সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বাঙালি জাতীয়তা অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “মাননীয় স্পীকার, আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ– কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। …আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়’’।
এরপর স্পিকার তাঁকে বলেন- ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না’? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমাদেরকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোনো দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়”।
সংখ্যাগরিষ্ঠার জেরে সংবিধানে সেই বিলটি পাস হয়ে যায়। তারই প্রতিবাদে এমএন লারমা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে আসেন। বিএনপি সরকারের আমলে “বাঙালী জাতীয়তাবাদ” রহিত করে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে পুনরায় “৭২ এর সংবিধানের পুনঃ প্রবর্তনের কথা বলে ” বাঙালি জাতীয়তাবাদ” অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলতঃ এ দেশে বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত আদিবাসী সাংসদরা এর প্রতিবাদ তো করেনইনি উপরন্তু টেবিল চাপড়িয়ে এ বিলটি পাসে সমর্থন জানিয়েছেন এবং বিলে স্বাক্ষর করেছেন। যা আদিবাসী জনগণের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।