বর্বরতম লংগদু গণহত্যার ৩৪ বছর আজ

পার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের মৌন মিছিল

বর্বরতম লংগদু গণহত্যার ৩৪ বছর আজ। ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে সেটেলার বাঙালী ও রাষ্ট্রীয় বিশেষ বাহিনী মিলে জুম্মদের উপর সংঘটিত করে নৃশংস একটি গণহত্যার। এতে বহু জুম্ম নিহত ও আহত হয়। সেটেলার বাঙ্গালিরা জুম্মদের ঘরবাড়িতে লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস এবং খ্রিস্টানদের গীর্জা পুড়িয়ে দেয়।

এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আড়াই ঘন্টা পর লংগদুতে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের উপর প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু হয়। এই প্রতিশোধমূলক হামলায় কম করে ৩৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যায়। তবে এর প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আর আব্দুর রশিদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করা হলেও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন কারণ খুঁজে পায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ্যামনেস্টির ওই রিপোর্টে বলা হয়- “কম করে ৬টি গ্রাম আক্রমণ করা হয়, পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং খ্রিস্টানদের দু’টি গীর্জা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যারা বেঁচে যায় তারা আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ে ও জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং তাদের একটা বিরাট অংশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।”

এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘৮৯ সালের ৯ মে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারকলিপিতে তারা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন,- “উপজেলা সদরে সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ৩নং লংগদু মৌজার হেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকে (যারা হেডম্যানের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছিল) এই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদি সহ আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা, গুলি করে নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলি বাড়ীতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ী থেকে বের করে বাড়ীর পাশ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে পরে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সৎকার করা সম্ভব হয়নি।”

যে সময় এ গণহত্যা সংঘটিত হয় তখন ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসনামল। ফলে এ বর্বর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ সে সময়কার বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তবে পরবর্তীতে যখন ঘটনাটি প্রচার পায় তখন থেকেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়।

বর্বরতম এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। লোমহর্ষক এ গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঢাকার রাজপথে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ১৯৮৯ সালের ২১শে মে মৌন মিছিল সহকারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ এ বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবী করে।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩০ মে ’৮৯ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ঢাকায় মৌন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করে।

হত্যাকান্ডের সুদীর্ঘ ৩৪ বছর অতিবাহিত হলেও কোন সরকারই এসব গণহত্যার বিচার করেনি। কোন তদন্তের সঠিক রিপোর্টও পেশ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর হতে সেটেলার বাঙ্গালি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী মিলে জুম্মদের উপর ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত করেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন গণহত্যার বিচার জুম্ম জনগণ পাইনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত সেটেলার বাঙ্গালি ও রাষ্ট্রীয় বিশেষ বাহিনী কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণ, ও বিভিন্ন নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বিগত ২০১৭ সালের ২জুন সেই একই লংদুতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে প্রায় ৩০০ জুম্ম ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়া হয় এবং তিনটিলা গ্রামের গুণমালা চাকমা নামের ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

নানিয়াচরের আলোচিত ৬ হত্যাকান্ডের ৫ বছর আজ
জেএসএস নেতা অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা হত্যার ৫ বছর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu