ফাগুনের সাথে সেও বিদায় নিয়েছিল!

পার্বত্য চট্টগ্রাম

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

রক্তিম চাকমা

শহীদ শ্রী সুদীর্ঘ চাকমা

ফাগুনের সাথে সেও বিদায় নিয়েছিল! ১২ই মার্চ ২০১৩, মঙ্গলবার, ফাল্গুন মাসের ২৯ তারিখ। ফাগুন শেষের পথে। দুপুর সাড়ে ১২টা’র দিকে খবর এলো জেএসএস নেতা সুদীর্ঘ চাকমা সাংগঠনিক সফরে গিয়ে সফরসঙ্গী জীবন চাকমা, সুখেন চাকমা, গুনেন্টু চাকমাসহ ওঁৎ পেতে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন। টিভির হেডলাইনে চোখ বুলালাম। ফাগুন তার রঙ ছড়ানো গুটিয়ে নেয়ার সময়েই সুদীর্ঘও তার রঙ ছড়ানো বন্ধ করে দিয়ে গেলেন আজীবনের জন্য।

পাহাড়ের এ প্রজন্মের তরুণদের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় কে সব থেকে জনপ্রিয়, হয়তো একবাক্যে সকলেই বলে দেবে সুদীর্ঘ দা! ২০০২-০৩ সালের দিকে জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণের সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ছাত্র নেতা হিসেবে সকলের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শের। একসময় বাম ছাত্র সংগঠনে ছিলেন, সেখান থেকেই বোধয় ব্যানার লেখা, ফেস্টুন লেখা, দেয়ালে দেয়ালে ছিকা দেয়া আয়ত্ত করেছিলেন। ছাত্র পরিষদের কর্মীদের সাথে নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে নিজ হাতেই ছিকা মারতেন। রাত-দিন যখনই সুযোগ হয় নেমে পড়তেন কাজে। এসব ব্যানার লেখা, ছিকা মারা শেখাতেন কর্মীদের। নৈতিক শিক্ষা ব্যতীত কখনও খারাপ কিছুই শিক্ষা দেননি ছোট ভাইদের। আপন ভাইয়ের মত আগলে রাখতেন প্রতিটি কর্মীকে।

জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন একজন অতন্দ্র প্রহরী। জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষায় কখনো আপোষ করেন নি। তরুণদের নিয়ে ভাবতেন খুব বেশী। মদ, হিরোইন, গাজায় আসক্ত তরুণদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা যেন তার প্রতিনিয়ত ভাবনা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা নামে-বেনামে ক্লাবগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন, লিখেছেন। এসব ক্লাবগুলো জুম্ম তরুণদের সংগ্রামবিমূখ-আন্দোলনবিমূখ করে রাখার একটি ষড়যন্ত্র বলে তিনি মনে করতেন। জুম্ম যুব সমাজকে নেশায় ডুবিয়ে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে ধ্বংস ও পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নীল নকশা ইসলামিকরণ সম্প্রসারণবাদ সফল করার ষড়যন্ত্র বলে তিনি মনে করতেন।

ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত নিয়ে তিনি কতটা উদ্বীগ্ন ছিলেন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে তিনি কতটা সক্রীয় ছিলেন তা তার লেখা “ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও মনুষ্যত্বের মৃত্যু” নামক প্রবন্ধটি পড়লেই বুঝা যায়। যে মানুষটা কিনা সারাজীবন ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের চেষ্টা চালিয়েছে সে মানুষটিকেই মরতে হয়েছে সে সংঘাতে।

ফাগুনে প্রকৃতি যেমন উজার করে মেলে দেয় তার সৌন্দর্য-রুপ তেমনি সুদীর্ঘও আলো ছড়িয়েছেন পাহাড় ছাড়িয়ে গোটা বাংলাদেশে। তিনি যেমন নিজের সংগঠনের কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় তেমনি একসময়কার বন্ধু প্রতীম সংগঠন ইউপিডিএফ কর্মীদের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন। সাথে সকল নিপীড়িত মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের কাছেও যে তিনি প্রিয় নন তা নয়, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে উনাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এমন নৃশংস ঘটনা তারা সংঘটিত করেছিল।

জুম্ম জনগণকে নিয়ে তার ভাবনা, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে তার ভাবনা, পর্যটন স্পট কিভাবে জুম্মদের ক্ষতি করছে তা নিয়ে ভাবনা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামি সম্প্রসারণবাদ নিয়ে তার যে ভাবনা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিরুদ্ধে তার যে ভাবনা, প্রগতিশীল ভাবধারার প্রতি তার যে আকাঙ্খা, নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে তার যে ভাবনা, নারী অধিকার নিয়ে তার যে ভাবনা, নারী নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ ইত্যাদি তার সেসব দর্শনগুলোকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। চর্চার মাধ্যমে তার চিন্তাগুলোকে বাস্তবে রুপদানের মাধ্যমেই আমাদের পাহাড়ের এই অচলাবস্থাকে বদলাতে হবে। যে আকাঙ্খা নিয়ে জুম্ম জনগণ লড়াইয়ে নেমেছে তা পূরণ করতে হবে।

সেই ফাগুনের মত যেন আর অন্য কোন সুদীর্ঘ বিদায় না নেয়, আলো ছড়ানো বন্ধ না করে। এই সুদীর্ঘ-মিঠুনদের একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে খুব বেশী প্রয়োজন হবে, হয়তো সেদিন নিঃশব্দে অভিশাপ দিয়ে যাবে এই আমাদের মাতৃভূমি। যে মাতৃভূমির, যে মাটির রক্ষা করতে সুদীর্ঘ-মিঠুনরা সোচ্চার ছিল। সুদীর্ঘ, জীবন, সুখেন, গুনেন্টুদের আত্মবলিদান যেন জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা হয়।

আগামী ১২ই মার্চ ২০২২ইং সুদীর্ঘ চাকমা, জীবন চাকমা, সুখেন চাকমা, গুনেন্টু চাকমা হত্যার ৯ বছর।

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

সুদীর্ঘ চাকমাসহ তিন সহকর্মীর ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত
খাগড়াছড়িতে নারী দিবস উপলক্ষে মহিলা সমিতি’র আলোচনা সভা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu