সভাপতি সুজন চাকমা (ঝিমিট), সাধারণ সম্পাদক নিশান চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মনতোষ ত্রিপুরা।
সিএইচটি ভ্যানগার্ড
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ২১তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন সুজন চাকমা (ঝিমিট), সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন নিশান চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মনতোষ ত্রিপুরা।
“পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে ছাত্র ও যুব সমাজ এগিয়ে আসুন” এই স্লোগানে আজ (২১জুন ২০২৪) সকাল ১০ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুরস্থ জেবিসি রেস্টুরেন্ট হলরুমে এ কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ও দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী বিমল কান্তি চাকমা। দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী সুজন চাকমা (ঝিমিট)। এরপর বেলুন উড়িয়ে ২১তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলনের উদ্বোধন করা হয়।
সমাবেশে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিশান চাকমার সঞ্চালনা ও বিদায়ী সভাপতি শ্রী সুজন চাকমা (ঝিমিট) এর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য শ্রীমতি রত্না তঞ্চঙ্গ্যাঁ; জেএসএস খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী প্রীতি খীসা, খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমা; জেএসএস মাটিরাঙ্গা থামা কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা দীপু চাকমা; পিসিপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেএসএস’র কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য শ্রী রাজ্যময় চাকমা; সাবেক ছাত্র নেতা ও জেএসএস’র কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য জগদীশ চাকমা; যুব সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রী জ্ঞান প্রিয় চাকমা প্রমূখ।
সম্মেলনে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন শ্রী মনতোষ ত্রিপুরা এবং সামগ্রীক প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক শ্রী সুনয় চাকমা। এরপর পিসিপি’র বিভিন্ন কলেজ, থানা, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা ও মহানগর কমিটির প্রতিনিধিরা বক্তব্য প্রদান করেন। বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে বক্তব্য প্রদান করেন বিদায়ী দুই সহ-সভাপতি এল্টন চাকমা ও সুনেন্টু চাকমা প্রমূখ।
বিশেষ অতিথি বক্তব্যে শ্রী প্রত্যয় চাকমা বলেন, পূর্বেকার ছাত্র পরিষদ ও বর্তমান ছাত্র পরিষদের মধ্যেকার ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আগেকার দিনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ যেভাবে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে এসেছিল বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বাস্তবতার কারণে সেভাবে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ভূমিকা রাখতে পারছেনা। তথাপিও পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভাটার সময়ে নিভূ নিভূ করে হলেও আন্দোলনের গতিধারা অব্যাহত রেখেছে। এই ছাত্র সমাজের দিকেই পার্বত্যবাসী তাকিয়ে আছে। জুম্মদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ছাত্র-তরুণ সমাজ অকুতোভয় সৈনিক হয়ে পাহাড় থেকে পাহাড়ে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দেবে।
শ্রী প্রীতি খীসা বলেন, ভূগোল না জানলে মানুষ অন্ধ হয় এবং ইতিহাস না জানলে মানুষ বোবা হয়। সুতরাং ছাত্র সমাজকে জুম্ম জনগণের জন্য কাজ করার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস সহ সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। আজকে আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাস না জানি, পূর্বজদের ইতিহাস না জানি তাহলে আমরা সঠিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে পারব না। সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস সহ নানা বিষয়ের উপর অধ্যয়ন-অনুশীলন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা এবং সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জুম্ম জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকে মূখ্য ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ঐতিহাসিক লড়াকু এই ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছিল লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। সেই থেকে আজ অবধি তার আপন স্বমহিমায় জুম্ম ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব ও জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে রাজপথের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রয়েছে এই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।
শ্রীমতি রত্না তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে তা আমরা সশস্ত্র আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষ করলেই দেখতে পাবো। এই ভূমিতেই কল্পনা চাকমার মত নারীরা জন্মগ্রহণ করেছে। জুম্ম জনগণের জন্য পাহাড় থেকে পাহাড়ে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সেজন্য নারীদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আজকে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে চীনে জুম্ম নারীদের পাচারের বিষয়ে কথা উঠে এসেছে, তা আমি যথেষ্ট ইতিবাচকভাবে দেখছি। চীনে নারী পাচার রোধে ছাত্র-তরুণ সমাজ সোচ্চার তা আমরা দেখছি। আজকে জুম্ম নারীরা যদি চীনে গিয়ে বিবাহ করে তাহলে তারা চাইনিজ সন্তান জন্ম দেবে, ফলতঃ আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটবে এবং আমরা সংখ্যায় আরো কমে যাবো।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে শ্রী বিমল কান্তি চাকমা বলেন, পাহাড়ে আন্দোলনের সূচনার সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি আমরা শিক্ষা আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করেছি। আজকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকেও সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে চালিয়ে নিতে হবে। তা না হলে আমাদের এই জুম্ম সমাজ সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবেনা। আজকে আমরা দেখি, ছাত্রীরা ভালো রেজাল্ট করলেও ছাত্ররা পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত তরুণ সমাজ, জুয়ায় আসক্ত তরুণ সমাজ কিভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারবে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকে এসব বিষয়ে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় ব্যাপকভাবে অভিযান চালাতে। আজকে আমরা দেখতে পায়, জুম্ম নারীরা বিজাতীয় বিবাহতে বেশী উৎসাহিত হচ্ছে। তার অন্যতম কারণ জুম্ম নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ছেলেরা ৮-৯ পাশ করে নেশাগ্রস্থ হয়ে ঝড়ে পড়ছে। ফলতঃ ব্যবধানটা সেখানেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা শান্তিবাহিনীরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সচেতনতা তৈরি করেছিলাম। সামাজিক অবক্ষয়তা রোধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলাম, আপনাদেরও সে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে লালন করে, বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে।
এরপর বিদায়ী কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী সুজন চাকমা ঝিমিট বলেন, ৮৯’র সেই ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ সময়ে জুম্ম জনগণের প্রয়োজনে একঝাঁক তরুণ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ গঠন করেছিল। সেই হতে আজ অবধি দীর্ঘ ৩৫টি বছর ধরে জুম্ম তরুণদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের সুখে দুঃখে সবসময় থেকেছে। আমরাও দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে যতটুকু সম্ভব নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে জুম্ম জনগণের তরে কাজ করেছি, আগামীতেও আমরা আমাদের এই আন্দোলনকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবো।
সভাপতি বক্তব্যের শেষে প্যানেল উপস্থাপন ও শপথ বাক্য পাঠ করান সাবেক ছাত্র নেতা ও জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির স্টাফ সদস্য শ্রী জগদীশ চাকমা মহোদয়।
সবশেষে, সভাপতি হিসেবে পুনরায় সুজন চাকমা (ঝিমিট), সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিশান চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মনতোষ ত্রিপুরাকে নির্বাচিত করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ২১তম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।