পাহাড়ি নারীর প্রতি সহিংসতা

মতামত

সঞ্জীব দ্রং

১. পাহাড়ি আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির খবর দেখে অনেকদিন পর আবারও কবিতা চাকমার ওই ‘জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই’ বা ‘জ্বলে উঠব না কেন’ কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত নব্বইয়ের শুরুতে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় আমি সাপ্তাহিক খবরের কাগজে নিয়মিত ‘আদিবাসী মেয়ে’ কলাম লিখতাম। কবিতা চাকমার এই কবিতা আমি আমার অনেক লেখায় বহুবার ব্যবহার করেছি। তরুণদের জন্য নানা বক্তৃতায় এই কবিতার কথা বলেছি। আমার বইয়েও এই কবিতার কথা আছে। আবার নতুন করে কবিতা চাকমার বইটি খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এই বইয়ের ইংরেজি রূপ। বইটি খুলে দেখলাম, আমাকে বইটি উপহার দিয়েছেন ৯ আগস্ট ২০১৬ সালে রোজী আপা ও সাজেদ কামাল ভাই। তারা লিখেছেন, ‘বন্ধুবরেষু সঞ্জীব দ্রংকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছাসহ’ কথাটি। সম্ভবত আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে শহীদ মিনারে সুলতানা কামাল আপার সঙ্গে তারা এসেছিলেন। কবিতা চাকমার কবিতার কয়েকটি লাইন,

‘জ্বলে উঠব না কেন!/যা ইচ্ছে তাই করবে-/বসত বিরান ভূমি/নিবিড় অরণ্য মরুভূমি,/সকালকে সন্ধ্যা/ফলবতীকে বন্ধ্যা।

‘জ্বলে উঠব না কেন!/যা ইচ্ছে তাই করবে-/জন্মভূমে পরবাসী/নারীকে ক্রীতদাসী,/দৃষ্টিকে অন্ধ/সৃষ্টিকে বন্ধ।

অবহেলা অপমানে ক্রোধ/ধমনীতে তুমুল রক্তের স্রোত/আঘাতে আঘাতে ভাঙে বিঘ্ন/চেতনার সমুদ্র তারণ্যে তীক্ষ্ন।

আমার সম্পূরক একমাত্র আমিই/জ্বলে উঠব না কেন!’

২. এই করোনার কঠিন সময়েও নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আমরা আশা করেছিলাম এই করোনার সময়ে মহামারীর কাছে সমর্পিত মুখোশপরা অসহায় মানুষ কিছুটা হলেও আত্ম-অনুসন্ধানী হবে। মানুষ উদ্ধত ও অহংকারী আচরণ পরিহার করে ভদ্র ও নম্র হবে, বিনীত হবে, অনুতপ্ত হবে আর সবার প্রাণে আত্ম-উপলব্ধিবোধ জাগ্রত হবে। কিন্তু হলো না। গত কয়েক মাসে পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে সব খবর বেরিয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতার যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রমাণ হয়েছে এই করোনাকালেও মানুষের হিংস্রতা, লোভ-লালসা, কুপ্রবৃত্তি, আর জঘন্যতম অপরাধ কমেনি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য সংগঠন মিলে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে শাহবাগে একটি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছে। তারা বলেছে, গত কয়েকদিনে আদিবাসী নারীর ওপর সহিংসতা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের পর পর কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি গোলাবাড়ি ইউনিয়নের বলপিয়ে আদাম গ্রামে নিজ বাড়িতে মানসিক প্রতিবন্ধী এক চাকমা নারী গণধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের সঙ্গে তাদের বাড়িতে লুটপাট করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক এক পাহাড়ি স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার কাটাবিল গ্রামে এক মনিপুরী নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক বলেছে, কভিড মহামারীর সময়েও আদিবাসী নারীর ওপর সহিংসতা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখে মধুপুর গড় অঞ্চলের পেগামারী গ্রামের বাসন্তী রেমার দখলিকৃত জমির কলাবাগান বন বিভাগ বিনা নোটিসে কেটে ফেলে দেয়। পরবর্তী সময়ে প্রশাসন এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং কিছু আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে আদিবাসী জনগণের আন্দোলনের মুখে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৫ শতাংশেরও বেশি নারী কর্মক্ষেত্রে বা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বহু ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৬১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা বাজার এলাকায়, ৪৫ শতাংশ মাঠে, ৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ৩ শতাংশ কর্মস্থলে সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। আবার, ৩৩ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতন, ৩৮ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ১৯ শতাংশ অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং ৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে, কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আদিবাসী নারীর ওপর ২৬টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আজকাল আদিবাসী ও নাগরিক আন্দোলনের মুখে নারী নির্যাতনের মামলায় কিছু দুষ্কৃতকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আইনের নানা ফাঁকফোকর ও জটিলতায়, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকৃত অপরাধীরা জামিন পেয়ে যায় এবং অনেক সময় ছাড়া পেয়ে যায়। ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে চলন্ত মাইক্রোবাসে আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। পাঁচ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো এই ধর্ষণ মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২৯ তারিখের মানববন্ধনে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছে। যেমন,  সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত আদিবাসী নারীর ওপর সব সহিংস ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা, আদিবাসী পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ নিরাপত্তা বিধান করা ইত্যাদি। আশা করি সরকার এসব দাবির প্রতি সম্মান রেখে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৩. আমি জাতিসংঘের একটি আদিবাসী বিষয়ক অধিবেশনে নিউ ইয়র্কে শুনেছিলাম আদিবাসী নারীরা ৫টি স্তরে বৈষম্যের শিকার হন। এক, আদিবাসী হিসেবে; দুই, নারী হিসেবে, তিন, দরিদ্র নারী হিসেবে; চার, প্রত্যন্ত অঞ্চল আর দুর্গম পাহাড় বনাঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে; এবং পাঁচ, অভিবাসী নারী হিসেবে। কথাগুলো কি সবাই ভেবে দেখবেন? এই আধুনিক যুগে এসেও ৫টি স্তরে বৈষম্যের শিকার আদিবাসী নারী? মহাশ্বেতা দেবী তার ‘গঙ্গা-যমুনা-ডুলং-চাকা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে ডুলং, নেংসাই, চাকা এসব নদীকে মেলাবার কাজ তো শুরুই হয়নি। কবে হবে তা জানি না। শুধু এটা জানি যে, পরিণামে মূলস্রোতকে, সমগ্র দেশকে ভীষণ দাম দিতে হবে এই উপেক্ষার। আর, কাদের উপেক্ষার? যারা সত্যিই তো অনেক, অনেক সভ্য আমাদের চেয়ে। মেয়ের বাপ পণ দেয় না, সতীদাহ বা পণের কারণে বধূহত্যা জানে না, কন্যাসন্তানকে হত্যা করে না, বিধবাবিবাহ স্বীকৃত, উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত, এমন উন্নত সামাজিক প্রথা যাদের, তাদের উপেক্ষা করলাম। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয়, মূলস্রোত সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে। কোনোদিন ভারতের সত্যি ইতিহাস লেখা হবে। সে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, যদি আমরা এখনো না বুঝি।’ মহাশ্বেতা দেবী কথাগুলো ভারতের আদিবাসীদের বিষয়ে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের উদ্দেশে বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের জন্য কথাগুলো কি প্রযোজ্য নয়? টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা উপন্যাসের শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, ‘আদিবাসীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কোনো সংবাহন বিন্দু তৈরি করিনি আমরা। অনাবিষ্কৃত রেখেই ধীরে, সভ্যতার নামে ধ্বংস করেছি এক মহাদেশ। নো কম্যুনিকেশন। একেবারে নেই? সেটা গড়ে তোলা কি অসম্ভব? গড়তে হলে যে অসম্ভব ভালোবাসতে হয় বহুকাল ধরে। কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা ওদের তো ভালোবাসিনি, সম্মান করিনি। এখন সময় কোথায়, শতাব্দীর শেষ সময়ে? সমান্তরাল পথ, ওদের পৃথিবী আমাদের পৃথিবী আলাদা, ওদের সঙ্গেও কোনো প্রকৃত আদান-প্রদান হয়নি, যা আমাদের সমৃদ্ধ করত।’ পরে লেখক আবার বলেছেন, ‘ভালোবাসা, প্রচ-, নিদারুণ, বিস্ফোরক ভালোবাসা পারে এ কাজে এখনো আমাদের ব্রতী করতে শতাব্দীর সূর্য যখন পশ্চিম গগনে, নইলে ভীষণ দাম দিতে হবে এই আগ্রাসী সভ্যতাকে। প্রতিবার আগ্রাসী সভ্যতা নিজেকে ধ্বংসই করে অগ্রসরণের নামে, ইতিহাস দেখ। ভালোবাসা, নিদারুণ ভালোবাসা, তাই হোক প্রথম পদক্ষেপ।’

বলা হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে দেশ। শুনতে ভালোই লাগে। এই করোনাকালেও নাকি আমাদের মাথাপিছু আয় ১,৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২,০৬৪ ডলার হয়েছে। তবে এই অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কেন পাহাড়ি আদিবাসী মানুষকে এখনো পথে নামতে হয়?

পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলেও ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার সমাজের কিছু মানুষ পিছিয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ এসব স্বীকার করে নিয়ে সবার জন্য ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলছে। এসডিজি প্রণীত হয়েছে। আমাদের দেশেও আদিবাসীসহ দলিত মানুষ, চা জনগোষ্ঠী, প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের মানুষ, পাহাড় ও অরণ্যের বাসিন্দা, সাধারণ প্রান্তিক কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে সবার জন্য ইনক্লুসিভ উন্নয়ন ব্যবস্থা দরকার। সবার আগে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা দূর করা দরকার।

লেখক কলাম লেখক ও মানবাধিকারকর্মী

 [email protected]

সূত্রঃ দেশ রূপান্তর

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

জেএসএস’র নানিয়াচর থানা সম্মেলন সম্পন্ন।
রাঙ্গামাটিতে বাড়িতে ঢুকে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu