সিএইচটি ভ্যানগার্ড
নিশান চাকমা
বাংলাদেশের ২০২৪ এর স্বৈরাচার বিরোধী যে ছাত্র অভ্যুত্থান হলো সেখানে মৌহিনী চৌধুরীর লেখা “মুক্তিরো মন্দিরো সোপানো তলে” গানটির ভূমিকা কতটা তা আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি। গানটির একটি লাইন এমন যে, “যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে, স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি- এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি”।
এই গানের কলিটির মতোই আমিও বলি, আমরা যে মাটিতে জন্মেছি সে মাটির সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক মিশে রয়েছে। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটির সাথে আমাদের নাড়ীর টান রয়েছে। মায়ের সাথে আমাদের যেমন নাড়ীর টান রয়েছে তেমনি এই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি, আকাশ-বাতাস, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত সবকিছুর সাথে আমাদের নাড়ীর টান রয়েছে। ভূমিষ্ঠের পর এই ভূমিতেই আমাদের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছে, এই ভূমি আমাদের ঠাঁই দিয়েছে। সুতরাং এই ভূমির সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, এই ভূমি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভূমি ১০ ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের, এই জুম্ম জনগণের মাঝেই আমাদের জন্ম। তাই এই ভূমি ও জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণা আমরা করতে পারিনা।
এই মাটি ও মানুষের দুঃসময়ে অতীতে যেমন আমাদের পূর্বপুরুষেরা অস্ত্র কাঁধে নিয়ে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করেছে তেমনি আজকের ছাত্র সমাজও মাটি ও মানুষদের রক্ষার প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্লোগান তুলেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশে-বাতাসে। আমি তাদের এই কার্যক্রমকে সাদরে গ্রহণ করছি এবং সাধুবাদ জানাচ্ছি।
বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর যে আগ্রাসন, পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার যে দৌরাত্ম্য তা আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করছি। আজকে বিশ্বব্যাপী পুজিবাদী আগ্রাসনের যে থাবা, সে থাবায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণও জর্জরিত। দারিদ্র পীড়িত জুম্ম জনগণ কষ্ঠের মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছে। সমাজের মানুষগুলো সকলেই আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ছে, সামগ্রীক চিন্তা-চেতনার জগৎ থেকে তারা ছিটকে পড়েছে। আজকে এমনি একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও আত্মকেন্দ্রীক চিন্তাভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে জুম্ম জনগণের মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব সুরক্ষার কথা চিন্তা করে ছাত্র সমাজ একটি বিপ্লব ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। হয়তো বাংলাদেশের ২৪ এর ছাত্র অভ্যুত্থান আমাদের জুম্ম ছাত্র সমাজের মাঝেও প্রবলভাবে প্রভাব ফেলেছে। মনিষীরা বলেছেন, “স্বপ্ন দেখতে শেখো এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজে লেগে পড়ো। মানুষ যে পথে হাঁটছে সে পথে হাঁটলেই হবেনা, নতুন পথের সন্ধান করে এগিয়ে চলো। হয়তো মানুষ নানা কিছু বলবে, কিন্তু লক্ষ্যটা রেখো অটুট”।
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো বিপ্লব সাধন হয়েছে সেখানে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখেছে ছাত্র ও তরুণ সমাজ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসেও জুম্ম ছাত্র-তরুণ সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। বিপ্লব মানেই পরিবর্তন আর সে পরিবর্তন আসে তরুণ সমাজের হাত ধরেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে সেই বহু আগেই, সেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে নতুন করে।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ইতিহাস আমরা সকলেই জানি, মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান আর হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত স্বাধীন হয়েছিল। এর পূর্ববর্তী ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা লড়াই করেছিলাম- সংগ্রাম করেছিলাম। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল না হওয়া স্বত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা ছিল আমাদের জুম্ম জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। হয়তো তখনকার সময়ে আমরা রাজনীতি সচেতন ছিলাম না, অধিকার সচেতন ছিলাম না। হয়তো তখনকার সময়ে আমাদের প্রথাগত যে নেতৃত্ব ছিল তারাও আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেনি। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে স্নেহ কুমার চাকমারা প্রচেষ্ঠা চালিয়েছিল কিন্তু সে আওয়াজ দিল্লির রাজ প্রাসাদের দেয়ালে পৌঁছায়নি কিংবা সে আওয়াজ আলুটিলা-ফুরোমৌন-তাজিনডংয়ের পাহাড় টপকাটে পারেনি।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রথম জুম্ম জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত করেছিলেন। রাজনৈতিক অসচেতন, অধিকার অসচেতন ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে মুক্তির বাণী শুনিয়ে জাগিয়েছিলেন। আজকে আমরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দেখানো পথেই এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছি। জুম্ম জনগণের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের প্রশ্নে, আজকে আন্দোলনের শুরু হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত এসেও আমরা আমাদের সেই জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার যে আন্দোলন সেখানেই আটকে রয়েছি। যদি জুম্ম জনগণের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হতো তাহলে হয়তো আমাদের জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার যে আন্দোলন তার কিছুটা হলেও আমরা করতে পেরেছি বলে মনে করতে পারতাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বা স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর পার করেছে। নানা ইতিহাসের স্বাক্ষী জুম্ম জনগণ। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগে জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণা, ষাটের দশকে জুম্মদের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ এবং তরুণ এমএন লারমাদের প্রতিবাদ ও জেল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জুম্মদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য গণ পরিষদের ভেতরে ও বাইরে এমএন লারমাদের সংগ্রাম। এমএন লারমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪ দফা দাবীনামা পেশ, বাকশাল গঠন ও ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা, এমএন লারমার আত্মগোপন ও ৭৭- সাল হতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংঘাত, ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমার আটক। জনসংহতি সমিতির আত্মকোন্দল এবং লাম্বা-বাদী গ্রুপের মাঝে সশস্ত্র সংঘাত ও জাতীয় চেতনার অগ্রদূত এমএন লারমাকে হত্যা। বাদী গ্রুপের সরকারের কাছে আত্মসমর্পন, পুনরায় নতুন করে সশস্ত্র আন্দোলন এবং সরকারের সাথে আলোচনা শুরু। ৮৭ তে জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক ৫ দফা দাবীনামা পেশ, সরকারের পক্ষ হতে ৯ দফা দাবীনামা এবং পুনরায় সংশোধিত আকারে জনসংহতি সমিতির ৫ দফা দাবীনামা পেশ। বিভিন্ন সরকারের সাথে ২৬ বারের বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের অধিকারের সনদ, জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ। এই চুক্তির সাথে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামে অসংখ্য আত্মবলিদানকারী জুম্ম জনগণের রক্তের দাগ মিশে আছে, এই চুক্তির সাথে এমএন লারমাসহ অসংখ্য বীর যোদ্ধার আত্মত্যাগের মহিমা মিশে আছে। এই চুক্তির সাথে সমগ্র জুম্মদের আবেগ-অনুভূতি মিশে রয়েছে। জনসংহতি সমিতির সমগ্র আন্দোলনের ইতিহাসের এক মাইলফলক এবং সফলতা এই চুক্তি।
সেই চুক্তি স্বাক্ষরের আজকে ২৭টি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। বিগত এই ২৭টি বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের গতিপথ নানা সময়ে নানা রুপে আবির্ভূত হয়েছে। চুক্তির পর পরই চুক্তির বিরোধীতা করে ইউপিডিএফের জন্ম হয়েছে। এরপর শুরু হলো নতুন করে জুম্ম জনগণের মাঝে গৃহযুদ্ধ। দেশে জরুরী অবস্থার সময় আবার জেএসএসের ভাঙন এবং গৃহযুদ্ধের নতুন মেরুকরণ। ১৭তে এসে ইউপিডিএফের ভাঙন এবং নতুন মেরুকরণ। বান্দরবানে কেএনএফের উত্থান, রাজস্থলী-কাপ্তাই এলাকায় মগ পার্টির উত্থান এক নতুন সমীকরণে এনে দাঁড় করিয়েছে জুম্ম জনগণকে। এরই মাঝে ২৪-এর ছাত্র অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে পাহাড়ের জুম্ম ছাত্র জনতা পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্যের দাবী নিয়ে নানা সভা-সমাবেশ সমগ্র জুম্ম জনগণকে এক আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ঐক্যের রুপরেখা কি? কর্ম পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ কি? তা ছাত্র সমাজ কি দিতে পেরেছে?
ঐক্য হয় এক পক্ষ আরেক পক্ষের মধ্যে। সেটা কিরুপে হতে পারে? ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য হয়, ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা আমরা জানি, ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস আমরা জানি, মধ্য প্রাচ্যে জেরুজালেমে ধর্মকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ঐক্য- মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য- শিখ সম্প্রদায়ের ঐক্যের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব হিন্দু মহাজোট, ইসলাম সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থা সহ নানা ধর্মের মানুষেরা বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ঐক্য হয়েছে- হচ্ছে। ভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়েছে, রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে ঐক্য স্থাপিত হয়। এখন জুম্ম ছাত্র সমাজের যে ঐক্যের ডাক তা কিরুপে প্রতিষ্ঠিত হবে? প্রথমত, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠনের ঐক্য হতে গেলে তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের মতাদর্শগত মিল থাকতে হবে এবং সর্বশেষ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং মতাদর্শগত মিল না থাকলেও অন্তত তাদের কর্মসূচীগত মিল থাকতে হবে।
ভিন্ন ভাষাভাষী পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভাষাগত এবং ধর্মের পার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে, খাদ্যভাসের মিল রয়েছে, অর্থনৈতিক জীবনধারার মিল রয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিককাল ধরে তারা বিভিন্ন শাসকদের কাছে একই কায়দায় শাসিত-শোষিত হয়ে আসছে। জুম্মদের উপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক শাসন করেছে কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক জীবনধারার উপর ভিত্তি করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জাতীয়তাবাদের নাম দিয়ে জুম্ম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সেই জুম্ম জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গিয়েছে। যার ফল হিসেবে আমরা আজকে জোর গলায় গর্ব করে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কথা বলি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সমীকরণ মূলত চুক্তির পক্ষ এবং বিপক্ষ। যা চুক্তি স্বাক্ষরকালীন সময় হতেই আমরা জানি। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই হচ্ছে স্ব-শাসন বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেটা কিরুপে হবে তা নিয়েই হয়তো দ্বন্ধ। একপক্ষ বলছে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ের মাধ্যমে জুম্মদের স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠা হবে আরেক পক্ষ বলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই স্ব-শাসন বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। যেখানে মতাদর্শগত যে ঐক্য তা সম্পূর্ণ বিপরীত, যে সমস্যা থেকেই ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফের জন্ম। আমরা যদি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটি বৈধ দলিল হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত কিন্তু পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আগাগোড়াও এখনও কিছুই নেই। সুতরাং ঐক্য যদি গড়তে হয় তাহলে মতাদর্শগত ঐক্য এবং উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বাস্তবায়নে একই কারণে কর্মসূচী দিয়ে কর্মীসূচীগত ঐক্য গড়ে তোলে বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা ব্যতীত কোন রাস্তায় খোলা নেই। সেই মতাদর্শগত এবং কর্মসূচীগত ঐক্য হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম।
হাজার হাজার জুম্ম জনগণের রক্তের দাগ লেগে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে, জুম্ম জনগণের জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার রক্তের দাগ লেগে রয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে, সমগ্র জুম্ম জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষা, আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা মিশে রয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে। কিন্তু সেই সব তোয়াক্কা না করে চুক্তির বিরোধীতা করে প্রসীত-রবি শংকর-সঞ্চয়রা ইউপিডিএফ গঠন করেছে। তারা জুম্ম জনগণের এতদিনের ত্যাগের মহিমাকে ম্লান করে দিয়েছে। এই চুক্তির হয়তো বহু ভূল ধরা যায়, কিন্তু এই দুর্বল চুক্তি বাদ দিয়ে ইউপিডিএফ দীর্ঘ ২৬টি বছরে কোন সবল চুক্তি করতে পেরেছে? পারেনি, পেরেছে শুধু ২০২২ সালের ৯ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ঘষামাছা করে পানছড়িতে এক অবসর প্রাপ্ত সেনা অফিসারের কাছে সেই কপি তুলে দিতে। তাও সরকারের কোন প্রতিনিধির সাথে নয়।
সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি কোন আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত হতে হয় তা হতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে কেন্দ্র করেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে যদি এককাতারে নিয়ে আসতে হয় তাহলে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব। সকল দলের মধ্যে যদি চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মসূচীগত ঐক্য স্থাপিত করা যায় তবেই আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে এককাতারে আনা যাবে। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শুধুমাত্র লিখিত একটি কাগজ নয়। এটি সমগ্র জুম্ম জনগণের আন্দোলনের ফসল, জনসংহতি সমিতির দীর্ঘ বছরের আন্দোলনের একটি সফলতা এবং মাইলফলক। এই চুক্তি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক সমাদৃত এবং এটি বৈধ একটি চুক্তি। এই চুক্তির কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর হতে শুধুমাত্র মিছিল-স্লোগানে-সমাবেশে-ব্যানারে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের কথা থাকলেও দীর্ঘ ২৬ বছরের অধিক আন্দোলনের পরও পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের সঠিক রূপরেখা জুম্ম জনগণের মাঝে উপস্থাপন করতে পারেনি এবং এতবছরে কোন সরকারের সাথে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত করতে পারেনি।
সুতরাং যে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের রুপরেখা জুম্ম জনগণের মাঝে এখনো স্পষ্ট নয় এবং রাষ্ট্রের কোন প্রতিনিধির সাথে তারা এখনো সংলাপেই বসতে পারেনাই সেই পূর্ণসায়ত্তশাসনের আশা বাদ দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তখন এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইবে। দাদা-দাদী, নানা-নানীরা রুপকথায় গল্প শুনিয়ে নাতি-পুতিদের যেভাবে ঘুম পাড়ায়, দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নামক রুপকথার গল্প শুনিয়ে জুম্ম জনগণকে ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টাই বলা যায়।
তাই আমি ইউপিডিএফের কাছে আহ্বান রাখবো চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আপনারাও সহযোগী হোন, আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের স্ব-শাসন বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখি। ছাত্র সমাজের যে ঐক্যের ডাক সে ডাকে সাড়া দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে কর্মসূচিগত ঐক্য গড়ে তুলি।
ছাত্র সমাজকে বলি, ভয় পেওনা- পৃথিবীটা সবার জন্য। বিশেষ করে এই তরুণ সমাজের জন্য। এই ছাত্র- তরুণ সমাজ যেভাবে চায় তারা সেভাবেই তাদের চারপাশকে সাজাতে পারে। নিজেদের আত্মবিশ্বাস শক্ত কর, যে উদ্দেশ্য-লক্ষ্য নিয়ে পথে নেমেছো তার জন্য দৃঢ় সংকল্প কর। পথটা মসৃণ নয় আবার অসম্ভবও নয়। কিন্তু কি উপায়ে এর সমাধান হবে তার সঠিক মূল্যায়নটুকু করতে চেষ্টা করো।
পাহাড়ের নেত্রী কল্পনা চাকমা বলে গিয়েছেন, “রণাঙ্গনের সাড়িতে আমরা হবো অগ্রণী সৈনিক”। কল্পনা চাকমার সেই কথা বাস্তবে রুপ দিতে আমাদের জুম্ম ছাত্র-তরুণ সমাজ জুম্ম জনগণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেবে, আলোর দিশা দেখাবে সেই প্রত্যাশা রাখি।
[মতামত লেখার দায় সম্পূর্ণভাবে লেখকের]