সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় চেতনার অগ্রদূত, জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও সাবেক সাংসদ বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৮৫তম জন্মবার্ষিকীতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ (১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪) খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুরস্থ জেবিসি রেস্টুরেন্টে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটি সংগ্রামী সভাপতি শোভা কুমার চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক প্রীতিকুমার চাকমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংগঠনটির সহযোগী সংগঠন আদিবাসী শ্রমজীবি কল্যাণ সমিতি বিষয়ক সম্পাদক সোহাগ চাকমা।
জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভোলাস ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন জনসংহতি সমিতির খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি কিরণ চাকমা। সভায় উপস্থিত থেকে আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নৈতিকা দেওয়ান, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিশান চাকমা, জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সভাপতি সুনীল চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রত্যয় চাকমা প্রমূখ।
বক্তারা বলেন, ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মুক্তির বাণী শুনিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শ, চিন্তা-চেতনা আমাদের অনুকরণীয় ও পাথেয়। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় যতদিন পৃথিবীতে মানব সভ্যতা থাকবে ততদিন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চিন্তাধারাগুলি নিপীড়িত মানুষের মনে আশার সঞ্চার করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ১৯৫৬ সালে পাহাড়ী ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন। ষাটের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের ভয়াবহতার কথা বুঝতে পেরে তিনি পাকিস্তান সরকারের কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে লিফলেট বিলি করে এর প্রতিবাধ জানান তার কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে। এক পর্যায়ে ১৯৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে পাকবাহিনীরা আটক করে নিয়ে যায়। ১৯৬৬ সালে সন্তু লারমা ও অনন্ত বিহারী খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি” এই সমিতি’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের মানুষদের মাঝে একটা প্রগতিশীল জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলা। ১৯৭০ সালে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে উত্থাপন করা হয় ১৬ দফা দাবীনামা । এই দাবীনামায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবী ছিল অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবী।
বক্তারা আরো বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের গণ পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে গণ পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। এরপর জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য সংবিধান রচনাকালে সংবিধানে যাতে জুম্মদের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি যাতে পুনর্বহাল রাখা হয় সেসবের বিষয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সোচ্চার ছিলেন। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের কথা নয়, সংবিধানে বাংলাদেশের অন্যান্য সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সহ খেতে-খাওয়া মানুষের কথা, মাঝি-মাল্লা, রিকশা চালক, মেথর, কৃষক-শ্রমিকদের কথা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করণের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠার অজুহাতে এমএন লারমার সেসব দাবীনামাগুলো উপেক্ষা করে উপরন্তু বাংলাদেশের সকল নাগরিককে জাতি হিসেবে বাঙালি বলে সংবিধানে পরিচিত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে লারমা সেদিন এর তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং সংসদ থেকে ওয়াকাউট করে চলে আসেন।
এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪দফা দাবীনামা উত্থাপন করা হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সেই দাবীনামাকে উপেক্ষা করে তাদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং লারমার উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন “লারমা তুমি কি মনে কর। তোমরা আছ ৫/৬ লাখ বেশি বাড়াবাড়ি করো না। চুপচাপ করে থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না (হাতের তুড়ি মেরে মেরে তিনি বলতে লাগলেন) প্রয়োজনে ১, ২, ৩, ৪, ৫ – দশ লাখ বাঙ্গালী অনুপ্রবেশ করিয়ে তোমাদেরকে উৎখাত করবো, ধ্বংস করবো।”
এইভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো, তখন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের কথাও এম এন লারমা ভাবলেন। অর্থাৎ স্বশস্ত্র সংগ্রামের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে, ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি গড়ে উঠল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা “শান্তিবাহিনী”। পাশাপাশি এম এন লারমার বলিষ্ট নেতৃত্বে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের মাঝে তিনি আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন। আজকের এই সময়ে এসে এমএন লারমা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত জুম্ম জনগণকে যেভাবে তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন করেছেন, আন্দোলনের পথ বাটলে দিয়েছেন তার জন্য সমগ্র জুম্ম জনগণ তার কাছে আজীবন ঋণী থাকবে। এমএন লারমার আগে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে সংগঠন গড়ে তোলা হলেও তার মত করে এত সূদূর প্রসারী চিন্তাধারা কেউ করতে পারেনি এবং তার প্রদর্শিত মত-পথের পার্বত্য চট্টগ্রামে যে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল জুম্ম জনগণের মাঝে এটি একটি মাইলফলক।
বক্তারা বলেন, এমএন লারমা যে উদ্দেশ্য-লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন এখনো সেখানেই আমরা আটকে রয়েছি, বরঞ্চ আমাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এমএন লারমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়নে আগামীর তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণ সমাজকেই তার প্রদর্শিত আদর্শ, মত, পথের অনুশীলন, অনুকরণের মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে মুক্তির স্বাদ দিতে হবে।