চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

আজ ১৩৯তম মহান মে দিবসে চট্টগ্রাম নগরীতে জুবিলি সড়কের নিউ মার্কেট মোড়ে সকাল ১১.০০ ঘটিকার সময়ে “শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দলমত নির্বিশেষে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হোন” এই স্লোগানে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ও আদিবাসী শ্রমজীবি কল্যাণ সমিতির র্যালি ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে গণসংগীত পরিবেশন করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলা কমিটির কার্যকরী সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মৃণাল চৌধুরী। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ( সিপিবি) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলা কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক নূরছাফা ভূঁইয়া।

মহান মে দিবসের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মছিউদ-দৌলা, এড. জহিরউদ্দিন মাহমুদ, নাভার সিবিএর সভাপতি মোঃ আবু তাহের, রাহাত উল্লা জাহিদ, মোঃ রাসেল হোসেন, আদিবাসী শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি রমেল চাকমা, সভাপতি নিখিল চাকমা, বেকারি শ্রমিক নেতা মোঃ জসিম উদ্দিন, এলপিজি (টোটাল) গ্যাস নেতা আবদুর রহমান, গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা পূর্ণ দাস ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিক নেতা মোঃ পারভেজ প্রমুখ।
সমাবেশে প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস লিঃ, নাভানা ব্যাটারীজ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ),গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র,আমাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি,
আদিবাসী শ্রমজীবী সমিতি, নির্মাণ, হোটেল, বেসরকারি হাসপাতাল, চা, পোশাক, রিকশা, পরিবহন, জাহাজভাঙা, পাটকল শ্রমিকসহ বিভিন্ন সংগঠন অংশ নেয়।

বক্তারা বলেন, ১৮৮৬ সালে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল, তা এখনো চলছে। শ্রমিকদের আট ঘণ্টার কর্মঘণ্টা ও ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা যায়নি। কর্মক্ষেত্রে তাঁরা এখনো নিপীড়নের শিকার। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকের ঘামে গড়ে উঠেছে এই দেশ, এই উন্নতি। তাই শ্রমিক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। জনগণ বাঁচবে।’
বক্তারা আরও বলেন, ‘সরকার একটা শ্রম সংস্কার কমিশন করেছে। এই কমিশন স্থায়ী জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, রেশনিং প্রথা চালুসহ নানা সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।’ ন্যায্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের জন্য এখনো শ্রমিকদের লড়াই করতে হচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে নিপীড়িত শ্রমিকদের এই লড়াই ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার আহবান জানানো হয়।

বক্তব্যে নিখিল চাকমা বলেনঃ চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকার এলসিবি গার্মেন্টসে অসুস্থ অবস্থায় ছুটি না পেয়ে এক আদিবাসী তরুণ শ্রমিক, উৎপল তঞ্চঙ্গ্যা প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি ফ্যাক্টরিতে ফিনিশিং হেলপার পদে কাজ করতেন। উৎপল গত ২৬ এপ্রিল থেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ছুটির আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার আবেদন গ্রহণ করেনি। চাকরি হারানোর ভয়ে তিনি বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজে যোগ দেন। গত ২৭ এপ্রিল সকালে আরও দুর্বল শরীরে দ্বিতীয়বার ছুটির আবেদন করেন উৎপল। তবে ফের ছুটি না দিয়ে তাকে জোর করে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। দুপুর একটার দিকে শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে তৃতীয়বার ছুটির আবেদন করেন তিনি। অবশেষে সন্ধা ৭.০০ ঘটিকায় ছুটি পান, কিন্তু তখন উৎপলের শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। পরবর্তীতে তাকে দ্রুত বেপজা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খারাপ হলে পরবর্তী ফৌজদারর হাট ডায়রিয়া হাসপাতালে নেওয়ার পথে বন্দর সল্টগোলা রেল ক্রসিং অতিক্রম করতেই সিএনজি গাড়ীতে থাকা অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই তরুণ আদিবাসী পোশাক শ্রমিক।
চট্টগ্রাম সিইপিজেড এলসিবি পোশাক শ্রমিক উৎপলের মৃত্যুর জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণই সরাসরি দায়ী করেন। কর্তৃপক্ষের এহেন কর্মকান্ডকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং সুপারভাইজার মোঃ আনোয়ার হোসেন যথাযথ শাস্তি প্রদানের দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত মাধ্যমে বিচার ও যথাযথ ক্ষতি পূরণের দাবি জানান।
তিনি আরও বলেন, পোশাক শ্রমিক উৎপল তঞ্চঙ্গ্যার মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়। এটি শ্রমিকের জীবন নিয়ে প্রতিষ্ঠানিক অবহেলার একটি ভয়াবহ উদাহরণ।
শ্রমিকের ন্যূনতম মানবাধিকার নিশ্চিত না করে জোরপূর্বক কাজ করানোর সংস্কৃতি আজ ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের’ রূপ নিচ্ছে। উৎপলের মৃত্যু সেই নির্মম বাস্তবতারই আরেকটি মর্মান্তিক প্রমাণ। শ্রমজীবী নেতা নিখিল চাকমা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দলমত নির্বিশেষে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হোন” আহবান জানান।
সমাবেশ শেষে একটি লাল পতাকা মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রেল স্টেশন থেকে নিউ মার্কেট হয়ে কোতোয়ালি মোড়ে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।