ভ্যানগার্ড ডেস্ক
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২২ আজ। দিবসটি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। “মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে এগিয়ে আসুন”, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু কর- একযোগে এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
খাগড়াছড়ি সদর
সকাল ১০ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি সদরের একটি হলরুমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী প্রতিভাস চাকমার সঞ্চালনায় ও সভাপতি শ্রী রাজ্যময় চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ছাত্র নেতা ও জনসংহতি সমিতি জেলা কমিটির সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী প্রীতি খীসা। অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক ছাত্র নেতা ও জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমা; যুব সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী জ্ঞানপ্রিয় চাকমা প্রমূখ। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, বাঙালি জাতি পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু আজ সেই বাঙালি জাতি বাংলাদেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণে তেমন আন্তরিক নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেকার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবসান ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে চলে আসা সশস্ত্র সংঘাতের। সেই চুক্তির একটি ধারা হচ্ছে “স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দান, কিন্তু সেই চুক্তি স্বাক্ষরের দুই যুগ অতিক্রান্ত হলেও আজো তা বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু কিছু জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হলেও সেসব ভাষায় দক্ষ কোন শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়ে পাঠ দান ব্যাহত হচ্ছে। পৃথিবীতে মোট ৭ হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে, অনেকগুলো ভাষা হারিয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেজন্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া ও সমতলের অপরাপর ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় পাঠদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
দীঘিনালা
জনসংহতি সমিতির দীঘিনালা থানা কার্যালয়ে আজ সকাল ১০ ঘটিকার সময় ছাত্রনেতা নিটন চাকমার সঞ্চালনায় পিসিপি দীঘিনালা থানা কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক রিংকু চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা ও জনসংহতি সমিতি সমিতির দীঘিলা থানা কমিটির সংগ্রামী সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী সমীর চাকমা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী ঝিমিট চাকমা, স্কুল ও পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক শ্রী বিজয় চাকমা প্রমূখ। বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের ৪৫টির অধিক ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষার জন্য এবং তাদের জাতীয় অস্তিত্বকে স্বীকার করে সাংবিধানিভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে স্ব-স্ব মাতৃভাষায় যথাযথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
মহালছড়ি
মহালছড়িতে পিসিপির সহ-সাধারণ সম্পাদক শ্রী আপ্পি চাকমার সঞ্চালনায়, সভাপতি সুভাষ চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতি মহালছড়ি থানা কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী সন্তোষময় চাকমা। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, মানুষ জন্মের পর থেকে যে ভাষা শেখে তাই মাতৃভাষা- সেই মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য বাঙালীরা যেমনি লড়াই-সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে- আগামী দিনের লড়াই সংগ্রামে জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকেও প্রস্তুতি নিতে হবে। মাতৃভাষাকে রক্ষা তথা- জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষায় সকলকে সচেষ্ট ও সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়। যেসকল ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে সেসকল ভাষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ প্রদান, যেসকল ভাষার এখনো কোন পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়নি সে সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক লিপিবদ্ধ করণ এবং যে সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় বর্ণমালা নেই সে সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণমালা উদ্ভাবনের দাবী জানানো হয়।
পানছড়ি
২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ মহান ভাষা শহীদদের প্রতি পানছড়ি উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল ৮.০০ ঘটিকার সময়ে পানছড়ি বাজার হতে র্যালির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পানছড়ি থানা শাখা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, পানছড়ি থানা শাখা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ – পানছড়ি থানা শাখা’র পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় পুষ্পমাল্য অর্পণ করে।
২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২২ ইং উপলক্ষে সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় সময়ে পানছড়ি সদরস্থ এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পানছড়ি থানা শাখার উদ্যোগে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত আলোচনা সভায় পিসিপি পানছড়ি থানা শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্রী মিশুক চাকমার সঞ্চালনায়,সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপি পানছড়ি থানা শাখার সভাপতি শ্রী সুনয় চাকমা। শুরুতে আলোচনা সভায় জুম্ম জাতীয় চেতনার জাগরণের অগ্রদ্রুত, অবিসংবাদিত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সহ সকল জুম্ম বীর শহীদদের স্মরণে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকল ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অথিতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পানছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক শ্রীমতি রত্না তঞ্চঙ্গা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ – আইন বিষয়ক সম্পাদক শ্রী প্রশান্ত চাকমা। আরও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পানছড়ি থানা শাখা কমিটির সভাপতি শ্রী বিমলেন্দু চাকমা।
স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি পানছড়ি থানা শাখার সদস্য শ্রী রিগ্যান চাকমা। আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, পানছড়ি উপজেলা শাখা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী জুম মান চাকমা, পিসিজেএসএস পানছড়ি থানা শাখা কমিটির যুব বিষয়ক সম্পাদক শ্রী রবিন ত্রিপুরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, পানছড়ি থানা কমিটির সভাপতি শ্রী নয়ন্টু চাকমা প্রমুখ ব্যক্তি।
বক্তারা বলেন, মা ! মাতৃভাষা !! মা আর মাতৃভাষার মধ্যে মাতৃদুগ্ধের চিরন্তন সম্পর্ক। মাতৃভাষা বললে গর্ব অনুভব হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বললেই শিহরণ সৃষ্টি করে। বিশ্বজুড়ে সকলেই প্রকৃতিকে সমীহ করে। প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের জীবন, জীবিকা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষার যোগ আছে। আদিবাসীদের ভাষা কে এই জন্য প্রাকৃতিক ভাষাও বলা হয়। বিশ্বের প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, সাম্প্রতিক কালে ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের নিবিড় যোগ আছে। প্রকৃতিকে বাঁচাতে গেলে আদিবাসীদের বাঁচাতে হবে । আদিবাসীরা বাঁচলেই প্রকৃতি বাঁচবে। প্রকৃতি বাঁচানোর তাগিদেই আদিবাসী বাঁচানোর তাগিদ আজ বিশ্বজুড়ে। আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি বাঁচানোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে ।
বক্তারা আরো বলেন, আমাদের সকলকেই বুঝতে হবে, নিজের মাতৃভাষা থেকেই জন্ম হয় জাতীয়তাবাদের। মাতৃভাষা বিপন্ন হলে আত্মপরিচয়, জাতিসত্তা, অস্তিত্ব বিলীন হয়। পরিত্রান পেতে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে স্ব-জাতি, স্ব-ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকতে হবে। থাকতে হবে সরকারি ভাবে ভাষা চর্চার সুযোগ, প্রয়োগের সুযোগ সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং ব্যবহারের নিজস্ব ক্ষেত্র। আলোচনা সভা থেকে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক স্ব- স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানানো হয় এবং সভাপতির সমাপনী বক্তব্য মধ্যে দিয়ে আলোচনা সভা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।