মধুপুর বনে বাসন্তীদের হাহাকার।

মতামত

সঞ্জীব দ্রং

রাষ্ট্রযন্ত্র যে তার সাধারণ ও গরিব মানুষের সঙ্গে কী রকম নিষ্ঠুর আচরণ করে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মধুপুর বনের বাসন্তী রেমা ও তার পরিবার। এই কয়েকদিনে আমি কয়েক দফা কথা বলেছি বাসন্তী ও তার মেয়ে শ্রাবন্তী রেমার সঙ্গে। শেষবার যখন কথা বলেছি সন্ধ্যায়, তখন বনে ঝর ঝর বৃষ্টি হচ্ছিল। ১৪ তারিখ সকালের পর থেকে তাদের জীবন বদলে গেছে। বাসন্তী রেমা জানালেন, যেদিন সকালে বন বিভাগ শ্রমিকদের দল নিয়ে তার কলাবাগানের ৫০০ গাছ কেটে ধ্বংস করে দেয়, সেদিন সকাল থেকে তিনি তার মেয়ে শ্রাবন্তীকে নিয়ে গ্রাম থেকে একটু দূরে দিনমজুরির কাজে গিয়েছিলেন। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বাগানের কলাগাছ কেটে ফেলার খবর পেয়ে মা ও মেয়ে দৌড়ে আসেন। ততক্ষণে বন বিভাগের নিয়োজিত শ্রমিকরা কলাগাছ কেটে শেষ করে ফেলেছে এবং জমিতে একাশিয়া জাতীয় চারা লাগাতে শুরু করে দিয়েছে। বাসন্তী রেমা বললেন, বহু কষ্টে, ‘আশা’ এনজিওর কাছ থেকে ৪০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে তারা প্রথমবারের মতো কলা আবাদ করেছিলেন। আশা’কে সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় এগারশো টাকা। কলাগাছ বড় হয়েছিল এবং কিছুদিনের মধ্যে গাছে ‘সবক’ বা ফুল আসত। বন বিভাগ এক নিমিষে তার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিল। পরে বাসন্তীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মেয়ে শ্রাবন্তী টাঙ্গাইলে কুমুদিনী সরকারি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল। কলেজের হোস্টেলে থাকত। বাবা, মা ও মেয়ে নিজেরাই ক্ষেতে কাজ করেছিলেন শ্রমিকের মজুরি বাঁচানোর জন্য। গ্রামের পাশে পীরগাছা খ্রিস্টান মিশনের ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকেও ঋণ নিয়েছিলেন তারা। এভাবে নানারকম জোড়াতালি দিয়ে, দিনমজুরি করে শ্রাবন্তীকে পড়াশোনার খরচ জোগানোর চেষ্টা করছিলেন। বাসন্তীর বড় ভাই হিমুর সঙ্গেও কথা বললাম। হিমু ঢাকায় কলেজে পড়ত আর নিজের খরচ জোগানোর জন্য যমুনা ফিউচার পার্কে চাকরি করত। করোনার কারণে পাঁচ মাস ধরে হিমু বাড়িতে, এবং অসুস্থ ছিল। সব মিলিয়ে অভাবের সংসারে আশা ও স্বপ্নের এই কলাবাগান হারিয়ে কঠিন এক সংকটে পড়েছে বাসন্তীদের পরিবার। এর মধ্যে আদিবাসীরা প্রতিবাদ করেছে, সমাবেশ করেছে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। মিডিয়াতে খবর ছাপা হয়েছে। টিভি রিপোর্ট হয়েছে। টকশো’তে আমিও অংশ নিয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু আমি যখন কয়েক দফা বাসন্তীদের সঙ্গে কথা বললাম, তখন জানলাম তাদের সংসার চালানো এখন হবে আরও কঠিন, আরও অনিশ্চিত। আমি মধুপুরের আদিবাসী তরুণ বন্ধুদের কাছে জানলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে সহৃদয় কয়েকজন বাসন্তী রেমার পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এই লেখার মাধ্যমে তাদের শুভেচ্ছা জানালাম।

২. আমি অনেক আগে বন ও পরিবেশ বিষয়ক একটি বইয়ে পড়েছিলাম, প্রশ্ন ছিল, কে বন ধ্বংস করে পিপল নাকি প্রফিট? জাতিসংঘ স্বীকার করেছে, এই পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ ভাগ হলো আদিবাসী। অথচ এই শতকরা ৫ ভাগ আদিবাসী পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ আদিবাসীরাই বন ও পরিবেশ, বৃক্ষ, নদী, পাহাড় পর্বত, প্রকৃতি রক্ষা করে। মধুপুর বনে বন বিভাগ কবে আসে? কত সালে বন বিভাগ এই শালবনে প্রবেশ করে ও নিয়ন্ত্রণ নেয়? বন আইন হয়েছে ১৯২৭ সালে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসকের আইন। ব্রিটিশরা চলে গেছে আজ থেকে ৯৩ বছর আগে। তারপর এলো পাকিস্তান। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ। ধরে নিলাম ১৯৫০ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে মধুপুর বনে বন বিভাগের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেখুন, ১৯৫০ সালের আগেও এখানে ছিল চিরহরিৎ বনভূমি। এই চিরহরিৎ শব্দের গারো অর্থ হলো ‘গ্রিমসিসি’।

২০০৫ সালের দিকে মধুপুর বন ও আদিবাসীদের নিয়ে আমরা একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছিলাম। ওই ফিল্মে এক গারো পুরুষের সাক্ষাৎকার আছে। তিনি বলছেন, এক সময় এখানে গ্রিমসিসি বন ছিল। এখানে কোথাও কোথাও মধ্য দুপুরেও বনের মাটিতে সূর্যের আলো পড়ত না। এমনি ঘন চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি ছিল। সেই বনভূমি এখন কোথায় হারিয়ে গেল? এটি তো প্রমাণিত যে, বন বিভাগ বনভূমি রক্ষা করতে পারেনি। এর মধ্যে মধুুপুরের বনে ন্যাশনাল পার্ক হলো। গারোরা তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। বিমান বাহিনীর জন্য বরাদ্দ হলো বনের হাজার একর জমি। সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হয়ে গেল আশির দশকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির সহায়তায় রাবার বাগান ও সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের কারণে। রাবার বাগানের ক্ষেত্র তৈরি করতে তখন হাজার হাজার একর প্রাকৃতিক শালবন কেটে, বনে আগুন জ্বালিয়ে বন সম্পূর্ণ উজাড় করে ফেলা হয়। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শালবন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রায়।

আমরা সব সময় বলেছি, বৃক্ষরোপণ মানে বন নয়। বন সৃজন করা যায় না। বন হলো প্রাকৃতিক। হাজার বছরের আদিবাসী ও বনবাসী মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির কারণে প্রাকৃতিক বন রক্ষিত হয়। আমাজন রেইন ফরেস্ট একই সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৫৬ সালের রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, ১৯৬২ ও ১৯৮৪ সালের ন্যাশনাল পার্ক, ২০০০-২০০৪ সালের ইকো-পার্ক প্রকল্প, ২০১৬ সালের রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা কোনোটাই বনের আদি বাসিন্দা গারো, কোচ, বর্মনদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শক্রমে হয়নি। বরং বন বিভাগ সব সময় বনের প্রকৃত রক্ষক যারা, তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে এই সব প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাই দেখা যায়, মধুপুর শালবনের সেই রূপ বহু আগেই হারিয়ে গেছে। এখন শালবন সামান্য টিকে আছে। আর বনের বিশাল অংশ জুড়ে আনারস, কলা, পেঁপে ও অন্যান্য ফসলের আবাদ। এই যে স্বাধীনতার পর এত প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো বনসম্পদ রক্ষার জন্য, তার হিসাব নেওয়া দরকার। বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আমাদের দেশে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়, তা মধুপুর বন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন, খাসিয়া ও গারো অঞ্চলের বন দেখলে বোঝা যায়। এখানে যারা রক্ষক, তারাই ভক্ষক হয়ে মহাউল্লাসে রাজত্ব করে যাচ্ছে। আর বনের অসহায় আদিবাসী ও গরিব বাঙালির বিরুদ্ধে শত শত বন মামলা দিয়ে তাদের জীবন ছারখার করে দিয়েছে।

৩. আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, বাসন্তী রেমার জমির কাগজপত্র আছে কি না? এই জমির মালিক কি বন বিভাগ? এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর আগেই দিয়েছি। বলেছি, বন বিভাগের জন্মের বহু যুগ আগে থেকে এই ভূমিতে, মধুপুরের বনে বাসন্তী রেমা ও তার পূর্বপুরুষের অবাধ বিচরণ। পাকিস্তান আমলে, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও আদিবাসীদের এই প্রথাগত স্বতঃসিদ্ধ ভূমি অধিকারকে রাষ্ট্রীয়

স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যদিও বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক সনদ আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী আইএলও কনভেনশন নম্বর ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে। এই সনদের ১১ অনুচ্ছেদে আছে, ‘আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত অধিকৃত ভূমির ওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।’ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত মালিকানাধীন, ভোগদখলীকৃত কিংবা অন্যথায় ব্যবহৃত কিংবা অধিকৃত ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।’ অর্থাৎ প্রথাগত ও ঐতিহ্যগতভাবে মধুপুরের বনে বাসন্তী রেমার ভূমির মালিকানা রয়েছে, যা আইএলও কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আর বাংলাদেশ সরকারও তা স্বাক্ষর করেছে।

মধুপুরের আদিবাসী নেতা ইউজিন নকরেক আমাকে বলেছেন, বাসন্তীদের এই ভূমি বহু পুরনো। বাসন্তী রেমা আমাকে বলেছেন, এই ভূমি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে। এই ভূমিতে তার পূর্বপুরুষের সমাধিক্ষেত্র আছে। এখানে তাদের বাড়িঘরও বহু পুরনো। এখনো এখানে কয়েকটি বড় কাঁঠালগাছ ও একটি আগাচিগাছ আছে। সুতরাং বন বিভাগ যা বলছে, তা হলো তাদের রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা বা ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণার সূত্র ধরে। এই যে বাসন্তী রেমার একমাত্র আয়ের উৎস কলাবাগান ধ্বংস করা হলো, তাও আবার এই করোনা মহামারীর মতো দুঃসময়ে, এটি চূড়ান্ত বিচারে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, তেমনি সুশাসন ও নৈতিকতা পরিপন্থী। বন বিভাগের ঐ অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের বিচার হবে কি না জানি না, আমি চাই সরকার বাসন্তী রেমার পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দ্রুত পৌঁছে দিক। শ্রাবন্তী রেমা যেন আবার কলেজে ফিরতে পারে। তার পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়।

৪. বর্তমান সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০০৮ সালে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লেখা আছে আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও এই ধরনের প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রতিশ্রুতি প্রতিশ্রুতিই রয়ে গেছে। আর মধুপুর বনের মান্দিরা ভালো নেই। এখানে অনেক গারো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আদিবাসীরা বলত, এক সময় এখানে আমরা ছিলাম আর বন ছিল। মধুপুর বনে চুনিয়া গ্রাম নিয়ে কবি রফিক আজাদ ১৯৭৫ সালে একটি কবিতা লিখেছিলেন। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া শিরোনামে তার কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম ‘চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে, বৃক্ষদের সাহচর্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃতপ্রস্তাবে খুব সুখে আছে। চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্য সমাজের কারু কারু মনে, কেউ কেউ এখনো তো পোষে বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া, চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।’

লেখক মানবাধিকারকর্মী ও কলামনিস্ট

[email protected]

মূললেখাঃ দেশ রুপান্তর

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Vitamin D can help reduce coronavirus risk by 54%: Boston University doctor
নিজ দেশে পরাধীন জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu