সিএইচটি ভ্যানগার্ড
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বায়ান্ন পেরিয়ে ৫৩ বছরে পদার্পণ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল ১নং আসনের ১৯৬৯ এ প্রাদেশিক নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্য ও ১৯৭৩ এ গণপরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র প্রাচীন ও বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠণ “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এতে এমএনলারমা আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হন।
১৯৭২ সালের ২৪ জুন রাঙামাটির “ইন্দ্রপুরী সিনেমা হল”এ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৬০ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। এতে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন “শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা”এবংসাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন” শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা”।
.জুম্মজনগণের অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার সংরক্ষণ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্ত্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে এ সংগঠণের আবির্ভাব। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জুম্মজাতিসত্ত্বাগুলোর ভাষা,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়োজনে আবির্ভাব এ সংগঠণের। ১৯৭২ সাল হতে বর্তমান পর্যন্ত জনসংহতি সমিতিজুম্মজনগণের সুখে দুঃখে সবসময় পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে।
জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার পর জুম্মজনগণের অধিকার আদায়ের তথা জুম্মজাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বাস্বায়ত্বশাসিত পার্বত্যঅঞ্চলের দাবীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনাকালে সংবিধানে “বাংলাদেশের সকল জনগণই বাঙ্গালী বলিয়া বিবেচিত হইবে” এই মর্মে সংবিধানে লেখা হয়। এরই প্রতিবাদে এমএনলারমা বলেন “আমি একজন চাকমা,আমার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ কেউ বলেনাই আমি বাঙালি। জানিনা আজ এই পবিত্র সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলা হচ্ছে। একজন বাঙালি যেমন একজন চাকমা হতে পারেনা, তেমনি একজন চাকমা বাঙালী হতে পারেনা।”
তখনি এর প্রতিবাদে এমএনলারমা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে চলে আছেন। এরপর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্বশাসন দাবী সম্বলিত ৪ দফা দাবী জনসংহতি সমিতি ও জুম্মজনগণের পক্ষ হতে পেশ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্টো পার্বত্য চট্টগ্রামে লাখ লাখ সেটলার ডুকিয়ে দিয়ে জুম্মজনগণকেজাতিগতভাবে নির্মুলীকরনের হুমকি দেন।
এরপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ এদেশের শাসকশ্রেণী রুদ্ধ করে দেয়। তখন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এমএনলারমাকে বলেন “লারমা তুমি এভাবে পারবেনা।তোমাকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে, সশস্ত্র আন্দোলন করতে হবে।” গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল, ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি এমএনলারমার নেতৃত্বে গোপনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা “শান্তিবাহিনী”।
এরপর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরসামরিক শাসন শুরু হলে এমএনলারমা আত্মগোপনে চলে যান। জিয়াউর রহমানের সরকার ও এরশাদ সরকারের আমলে লাখ লাখ সেটলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে আনলে, জুম্মরা উচ্ছেদ হন,ভূমিহারা হন। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট, হত্যা ইত্যাদি চালিয়ে জুম্মদেরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়।
১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে শান্তিবাহীনির সশস্ত্র সংঘাত হয়। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বারুদের গন্ধে মাতাল হয়ে উঠে। সহস্র জুম্মসৈনিক জাতীয় মুক্তির চেতনায় শান্তিবাহিনীতে নাম লেখান। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখার জন্ম হয়েছিল বলে, সবার মুখে মুখে নাম হয়েছিল “শান্তিবাহিনী”। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে মদ, জুয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মগুলোকে শক্ত হাতে দমন করেছিল বলে জনসাধারণ নাম দিয়েছিল “শান্তিবাহিনী”। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপ্লব সংগঠিত করেছিল শান্তিবাহিনী।
জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার সময়কালীন সময়ে এই সংগঠণের বেশীরভাগ নেতা বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বলে সেনাবাহিনীর তৎকালীন অনেকেই জনসংহতি সমিতির সংগ্রামকে নামদিয়েছিলেন “টিচার্স রিভ্যুলেশন” বা “শিক্ষক বিপ্লব”। স্বয়ং জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এমএনলারমা ছিলেন দীঘিনালা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এভাবেই শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য এদেশের শাসকশ্রেণীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছিল।
১৯৮৩ সালে জনসংহতি সমিতির ২য় জাতীয় কংগ্রেসকে কেন্দ্র করেজনসংহতির মধ্যে আত্মকোন্দল গড়ে উঠে। এমএনলারমা এই আত্মকোন্দলকে খুবই যত্নসহকারে নিরসন করার চেষ্টা চালিয়ে যান কিন্তু ব্যর্থ হন। এমএনলারমা এবং সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন লাম্বা গ্রুপ এবং প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বাধীন বেটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে জনসংহতি সমিতি।
লাম্বা গ্রুপ, যারা প্রগতিশীল আদর্শকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছিল, আর বেটো গ্রুপ যারা শ্রীঘ্রই এই সংগ্রামকে সমাপ্ত করতে চেয়েছিল। এরপর জনসংহতি সমিতির দুই গ্রুপের মধ্য সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। এই সশস্ত্র সংঘাতে ৮জন সহযোদ্ধাসহ বেটো গ্রুপের সশস্ত্র গ্রুপের হাতে ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ তে খাগড়াছড়ি জেলার,পানছড়ি উপজেলার খেদাড়াছড়া থুমে জুম্মজাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এমএনলারমা নির্মমভাবে শহীদ হন।
এরপর লাম্বা গ্রুপের হাল ধরেন এমএনলারমার ছোট ভাই ও শান্তিবাহিনীর তৎকালীন ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা। এরপর সন্তু লারমার নেতৃত্বে বেটো গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। আবার এদেশের শাসকশ্রেণীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ২৫ বছরের অধিক জুম্মজনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এদেশের শাসকশ্রেণীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা উপেক্ষা করে, বহু তাজা প্রাণের বিনিময়ে, বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে একরাশ সুখের আশা নিয়ে চুক্তি সম্পাদন করা হয়।
এই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমেই সমাপ্ত হয় জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগ্রাম, এবং বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় “শান্তিবাহিনী” নামক সশস্ত্র শাখাটির। জনসংহতি সমিতি ফিরে আসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে। আজো চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জনসংহতি সমিতি গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তির স্বাক্ষরের আজ ২৬টি বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির গুটিকয়েক ধারা ছাড়া সবকিছুই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
প্রতিটি নির্বাচনের সময় এলেই সরকার “পার্বত্য চুক্তি” বাস্তবায়নের ওয়াদা করলেও মূলত চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এদেশের শাসকশ্রেণী আন্তরিক নয়, যা তাদের কার্যকলাপে প্রমাণ দেয়। চুক্তির পর পাচঁ পাচঁবার চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলেও চুক্তি বাস্তবায়নের কোন প্রক্রিয়াই আমরা দেখতে পাইনা। আজ ২৬টি বছর ধরে জনসংহতি সমিতি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছে।