কাউখালী কলমপতি গণহত্যার ৪৩ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

সিএইচটি ভ্যানগার্ড

আজ ২৫ মার্চ ২০২৩। কান পেতে শুনছি সেনাবাহিনী ও সেটেলার দ্বারা সংঘটিত ৪৩ বছর আগে ২৫ মার্চ ১৯৮০ সালে ঘটে যাওয়া প্রথম গণহত্যার গল্পসব। রাঙ্গামাটির কাউখালীর মুখ পোয়া, পোয়া পাড়া, কাউখালী বাজার, তোং পাড়া এবং হ্যাডম্যান পাড়ার পাক্কা ৩০০ টি জুম্মের লাশ, বাঁচাও বলে জুম্মবিদের চিৎকার, বাবা-মামা বলে ডাকা ককই- চিজিদের চিৎকার

সেনাবাহীনির গুলিতে ভয়ে কেঁপে উঠা গর্ভবতি মারমা মহিলার আর্তনাদের ডাক শুনছি- অয়্যুশি– অয়্যুশি — জামা হিংগাইতেলে ? জু লেগাইলিলে? নবঃ পঃতেগা ! জালে ফ্রঃ রে? ( কে কোথায় আছে? কোথায় গেলো? বন্ধুকের আওয়াজ কেন? কি হয়েছে?

অয়্যুশি আর্মি তয়ঃ নবঃ রব্যা ঙাগো খঃরে । জ্যা — প্যাংফুলে অয়্যুশি ? আর্মির বন্ধুক তাক করে আমায় ডাকছে , কি করবো আমি?

গণহত্যার সূত্রপাতঃ

কলমপতি আর্মি জোনের প্রধান এক ধর্মীয় সভার নামে কলমপতি ইউনিয়নের পাহাড়ি নেতাদের জড়ো করান। সকাল বেলায় ঘোষণা দেয়া হয় পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের সংস্কার কাজে আর্মিরা সহায়তা করবে এবং সাধারণ পাহাড়িদের এই সংস্কার কাজের জন্য ডাকা হয়। সাধারণ পাহাড়িরা এতে সাড়া দিয়ে মিটিংএ উপস্থিত হয় এবং এরপর তাদের এক লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। লাইনে দাঁড়ামাত্র আর্মি সদস্যরা তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় বাজার চৌধুরী, কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরহিদর চাকমা সহ প্রায় শত ব্যক্তি। গুরুতর আহত হন ইন্দু কুমার চাকমা, পিটিয়া চাকমাসহ প্রায় ১২ জন। এদের রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই দিন পোয়াপাড়া

হত্যাকান্ড শেষে প্রায় ৩০ জন পাহাড়ি নারীকে জোরপূর্বক আর্মি ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় শিশু ও বৃদ্ধাদের ছেড়ে দেয়া হলেও তরুণীদের ছেড়ে দেয়া হয়নি, যাদের হদিস আর পাওয়া যায় নি।

সেটেলারদের হামলাঃ

আর্মিদের মদদেই সেটেলাররা পাহাড়িদের উপর চড়াও হয়। তারা কাউখালি, মুখপাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালি বাজার, তোংপাড়া এবং হেডম্যান পাড়া তছনছ করে ফেলে। সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং লুট করা হয়। সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজার বাড়িও লুট করা হয়। এছাড়াও, মুখপাড়া কিয়াং, তোংপাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়াপাড়া মন্দিরেরও ধ্বংস সাধন করে। কিয়াংগুলোর স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতলের বৌদ্ধমূর্তি, আসবাবপত্রসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়। হাতিরপাড়া ও কাউখালির দুইটি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়েও দেয় সেটেলাররা। সেটেলারদের হামলার মুখে পাহাড়িরা দৌড়ে পালিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং পরে ভারতের ত্রিপুরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ঘটনার পরবর্তীঃ

১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন জাসদের সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা জাসদের ঢাকাস্থ দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কলমপতি হত্যাকান্ডের কথা প্রথমে প্রকাশ করেন। এর পর পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ৫ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে এমপি উপেন্দ্র লাল চাকমাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় নি।

সংসদীয় কমিটির বিপরীতে স্বাধীনভাবে হত্যাকান্ডটি তদন্তের জন্য জাসদের এমপি শাহজাহান সিরাজ, উপেন্দ্র লাল চাকমা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক রাশেদ খান মেননসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট এক সত্য অনুসন্ধানকারী দল গঠন করা হয়। দলটি নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তাঁদের পরিদর্শনের সংবাদ পেয়ে প্রায় ৫০০ জন ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি কয়েক মাইল হেঁটে চেলাছড়ায় টিমের সাথে সাক্ষাত করে এবং তাদের দুর্ভোগের কথা জানায়। প্লেকার্ড ও পোস্টারের মাধ্যমে তারা সমতল থেকে অবৈধ আগমনকারীদের হামলায় হত্যাকান্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, নারী নির্যাতন- ধর্ষণ বন্ধের উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষা, ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মৃতদের দাহ, পাহাড়িদের জন্য আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার এবং সেটেলারদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানায়।

সত্য অনুসন্ধানকারী দলের বক্তব্যঃ

২১ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে সত্য অনুসন্ধানী দলটি ঘটনার বিবরণ দেন। তাদের বক্তব্য অনুসারে,

“ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর, আমরা ২৫ মার্চ ১৯৮০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রাধীন কলমপতি ইউনিয়নস্থ কাউখালি বাজারের আর্মির এক ইউনিট কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকান্ড ও নৃশংসতার প্রমাণ পেয়েছি। সদ্য আগত সেটলাররাও হত্যাকান্ড ও লুটতরাজে অংশ নেয়। এমনকি ঘটনার ১ মাস পরও গোটা এলাকা ভয়ের রাজত্ব বিরাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উচ্ছেদের শিকার হওয়া গরীব পাহাড়িরা নিজেদের ধ্বংস হয় যাওয়া গ্রামে ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। কারণ হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, যখন তখন মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সেটলারদের হুমকি প্রদান এসব চলছে।“

তারা আরো বলেন,

“একই সাথে আমরা সেটলারদের বাসকৃত বাড়িগুলোকে খুব ভালো অবস্থায় দেখেছি। এগুলো পাহাড়িদের জমিতে তৈরি করা হয়েছিল। এই সেটলারদের ভিন্ন জেলা থেকে সাপ্তাহিক রেশন ও আশ্রয়ের প্রলোভনে। একজন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জানিয়েছেন যে ২৬৩৭ পরিবারকে বাড়ি নির্মাণের জন্য প্লট এবং ৩০০ পরিবারকে চাষের জমি দেয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারকে সপ্তাহে ১২ সের গম প্রদান করা হয়। কিন্তু যখন সরকার কি সিদ্ধান্তের কারণে এখানে সেটলারদের নিয়ে আসা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করা হয় তখন স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। তারা আমাদের বলেন যে সেটলারদের ক্রমাগত আগমন বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে ইতিমধ্যে ২০ হাজার সেটলার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে।“

সবশেষে তাঁরা বলেন,

“এটি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট যে কলমপতির ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা ও পন্থায় সংঘটিত করা হয়েছে। “

সংবাদ সম্মেলনে তারা যেসকল সুপারিশ করেছিলেনঃ

১। কলমপতি ইউনিয়নে ২৫ মার্চ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও ঘাতকদের শাস্তি;

২। ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ পুনর্বাসন;

৩। ক্ষতিগ্রস্থ বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনঃর্নিমাণ, মন্দির ধ্বংস সাধনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাত দানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা;

৪। সেটেলারদের আগমন বন্ধ করা;

৫। যেসব সেটেলার ইতোমধ্যে এখানে বসতি গড়েছে তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নেয়া

৬। বাজারগুলোতে মালামাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে বাঁধা প্রত্যাহার।

গণহত্যায় নিহতের সংখ্যাঃ
খনো সঠিক সংখ্যা জানা যায় নি যে আসলে সেদিন কতজন মারা গিয়েছিলেন। গণহত্যায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া গুরুদাস চাকমা পরে সত্য অনুসন্ধান দলের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি পোয়াপাড়া হাইস্কুলের পশ্চিম কোণায় একমাত্র সেনাছাউনির পিছনে ৫০ জনেরও বেশি লাশকে গণকবরস্থ করতে দেখেছিলেন। ১ এপ্রিল ১৯৮০ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে উপেন্দ্র লাল চাকমা লাশের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি। “সঠিক নিহতের সংখ্যা অজানা, তবে অবশ্যই ২০০ এর কম নয়”।

১৯৮০ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখে নিউ নেশন পত্রিকায় ছাপা হয়, একটি সূত্র মতে জানানো হয়েছে যে কাউখালির এই সংঘাতে মাত্র ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আনুমানিক ধারণা করা হয় প্রায় ৩০০ জন এই গণহত্যায় নিহত হয়েছিল।

পোস্টস্ক্রিপ্ট
বাংলাদেশ সরকার সত্য অনুসন্ধান দলের সুপারিশ গ্রহণ করেনি এবং কোন ধরণের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করেনি। সংসদীয় কমিটি নামেমাত্র গঠন করা হয়েছিল। কোন ধরণের তদন্ত রিপোর্ট এখনো প্রকাশিত হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গণহত্যার হোতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী গণহত্যাগুলো সংঘটিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতকে কালো রাত হিসেবে অভিহিত করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার জন্য বিভিন্ন তৎপরতা যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৯ বছর পর অপারেশন সার্চলাইট সংঘটিত হওয়ার দিনেই সংঘটিত হয়েছিল “কলমপতি গণহত্যা” যার ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ার পথে।

ইতিহাস ফিরে আসে প্রতিবছর, প্রতিবার। ২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাত্রিও ফিরে আসে জীবনে। কিন্তু ২৫ মার্চের ‘কলমপতি গণহত্যা’ ফিরে আসে নিভৃতে।

বেঁচে থাকুক কলমপতি,
বেঁচে থাকুক লোগাং-লংগদু,
বেঁচে থাকুক পাহাড়ের সকল নাম না জানা শহীদরা।

তথ্যসূত্রঃ
১। এটাও আরেক ২৫ শে মার্চ , এবং গনহত্যা , কুঙ্গ থাঙ, ২৫ শে মার্চ, ২০১৮ ওমেন চ্যাপ্টার
২। হিল ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১৬ দিন পর মুক্তি পেলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট আনোয়ারুল হক
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাদ থেকে এক জুম্ম ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu