সাফজয়ী বাংলাদেশ ও আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণ

দেশপার্বত্য চট্টগ্রাম

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

সাফজয়ী বাংলাদেশ দল

গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, প্রথমবারের মত দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতলো বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। এমন শিরোপা’র জয়ে আনন্দে উল্লাসিত গোটা বাংলাদেশের মানুষ, সাথে গোটা বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনপদ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে এখনো। কারণ সাফজয়ী এই নারী ফুটবল দলে রয়েছে পাহাড় ও সমতলের ৭ আদিবাসী নারী। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এসেছে এ বিজয়।

আদিবাসী ৭ নারী ফুটবলারের মধ্যে রয়েছে পাহাড়ের ৫জন এবং সমতলের ২ জন। পাহাড়ের ৫ ফুটবলাররা হলেন মনিকা চাকমা, আনাই মগিনি, আনুচিং মগিনি, রুপনা চাকমা এবং ঋতুপর্ণা চাকমা। তাদের মধ্যে মনিকা চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার লক্ষীছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নে। যমজ বোন ডিফেন্ডার আনাই মগিনি ও ফরোয়ার্ড আনুচিং মগিনির বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাইভাইয়া পাড়ায়। অন্যদিকে মিডফিল্ডার ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালি উপজেলার মগাছড়ি চাকমা পাড়ায় এবং রুপনা চাকমার বাড়ি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়াচরের ভুঁইয়ো আদামে। যিনি বাংলাদেশ দলের হয়ে গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন এবং এ আসরের সেরা গোলরক্ষক হয়ে গোল্ডেন গ্লাবস লাভ করেছেন। তাদের বাড়ি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় হলেও তারা সকলেই উঠে এসেছেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমা ও কোচ শান্তিমুনি চাকমার হাত ধরেই তাদের হাতেকড়ি এবং স্বপ্ন যাত্রা।

পাহাড়ের পাঁচ নারী ফুটবলার ও সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমা

সমতলের দু’জন নারী ফুটবলার হচ্ছেন, ময়মনসিংহের কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মারিয়া মান্দা ও শিউলি আজিম। সমাজের নানা প্রতিকূল অবস্থা, বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আসতে হয়েছে তাদের এ পর্যন্ত। মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দার বাড়ি কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের পেছনে মন্দিরকোনা গ্রামে। ওই গ্রামে যেতে পার হতে হয় খরস্রোতা নেতাই নদ। সেতু না থাকায় দড়ি টেনে নৌকায় নদ পাড়ি দিতে হয়। নদের ওপারের মানুষের মধ্যেও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। মারিয়া এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি এখন এলাকাবাসীর গর্ব ও অহংকার। স্বপ্নজয়ী এই নারী ফুটবলাররা আরো আলো ছড়াবেন এই প্রত্যাশা সকলের।

বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে নারীদের ফুটবলে এই সাফল্য কট্টর পুরুষতান্ত্রিকতায় সজোরে একটা আঘাত হেনেছে বলা যায়। যেখানে নারীদের বোরখা-হিজাব পড়ে ঘরকুনো করে রাখার যে নীতি সে নীতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদও আমরা বলতে পারি। যেদেশে নারীদের ফুটবলকে বেহায়াপনা, অর্ধউলঙ্গ, শরীর দেখানো ইত্যাদি বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয় সেদেশে এরকম একটি বিজয় অবশ্মভাবী হয়ে উঠেছিল। ফুটবলাররা কে কিরকম সমাজের বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে উঠে এসেছে তারাই একমাত্র জানে। এখানে আসার পেছনে কত কটু কথাই না শুনতে হয়েছে সে কারণে ফাইনালের আগে ফুটবলার সানজিদা আক্তার লিখেছেন "যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।"

সমাজের এত এত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে যখন নারীরা দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে তখন সেখানে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণ সত্যিই আশার আলো জাগিয়েছে। আদিবাসী নারীরা দেখিয়ে দিয়েছে আদিবাসীদের সুযোগ দেওয়া হলে তারাও কিছু করে দেখাতে পারে। বিশেষ করে আশার আলো এই যে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই দেশে সংখ্যায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর নারীরা নিজেদের অবস্থান করে নিতে পেরেছে। যা তাদের কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও মেধার পরিচয় মেলে।

এ বিষয়টাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাঙালি নারীরা পারিবারিক ও সমাজের যে বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে না পারার কারণেই এতদিন এরকম সাফল্য বাংলাদেশ পায়নি। যারাই সমাজের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে তারাই দেশের জন্য সুনাম বয়ে নিয়ে এলো। এত এত সমাজের কটু কথা শুনে শুনে তারা যেহেতু এতদূর এসেছে তাই তাদের মনোবল এত দৃঢ় হয়েছিল যে, কেউ আর তাদের আটকাতে পারেনি। বলা যায় এতদিন যদি বাঙালি সমাজে নারী সমাজকে ঘরকুনো করে রাখার সংস্কৃতি না থাকতো, তাদেরকে খেলাধুলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা না হতো তাহলে আরো বহু আগেঈ বাংলাদেশের মেয়েরা এরকম সম্মান দেশের জন্য বয়ে নিয়ে আসতো।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী ও পুরুষ ফুটবলারদের বেতন নিয়ে যে বৈষম্য সে বৈষম্য বলার মত নয়। পুরুষ ফুটবলারদের বেতনের তুলনায় নারী ফুটবলারদের বেতন অতি নগণ্যই। এ বৈষম্য দূর করা অবশ্যই প্রয়োজন।

নারী ফুটবল দলে যেমনটা আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে তেমনি অন্যান্য খেলায়ও আদিবাসী নারীদের সুযোগ করে দেয়া উচিত। আশা করা যায় আদিবাসী নারীদের অন্যান্য খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে দেশের জন্য আরো অনেক সুনাম বয়ে আনতে পারবে। নারীদের পাশাপাশি আদিবাসী পুরুষদের ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে পুরুষরাও দেশের জন্য অনেক সম্মান বয়ে আনবে বলে ধরে নেয়া যায়। আদিবাসীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হলে তারাও যে কিছু করে দেখাতে তার প্রমাণ মারিয়া, ঋতুপর্ণারা, পুরুষদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে তারাও কিছু একটা করে দেখাবে এই আশাটুকু রাখা যায়।

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

পিসিপি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ শাখার ৯ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত
পানছড়িতে মহান নেতা এম.এন. লারমা’র ৮৩ তম জন্মদিবসে আলোচনা সভা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu