সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়িতে বর্ষীয়ান জুম্ম রাজনীতিবিদ, আজীবন সংগ্রামী, সাবেক গেরিলা নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি তাতিন্দ্র লাল চাকমা’র (মেজর পেলে) ২য় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতিন্দ্র লাল চাকমা ২০২০ সালের ১৩ই আগস্ট সকাল ৯.১৫ ঘটিকার সময় ফুসফুস সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ (১৪ আগস্ট ২০২২) সকাল ১০ ঘটিকার সময় জনসংহতি সমিতির খাগড়াছড়ি জেলা কার্যালয়ের প্রাঙ্গনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী সোহেল চাকমার (বিজক) সঞ্চালনায় ও যুব সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শ্রী জ্ঞানপ্রিয় চাকমার সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা কমিটির সভাপতি শ্রী আরাধ্যপাল খীসা; কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী প্রণব চাকমা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী বিভূরঞ্জন চাকমা প্রমূখ।
স্মরণসভার শুরুতে অস্থায়ী শহীদ ভেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পন করেন জনসংহতি সমিতি, যুব সমিতি ও পিসিপির নেতৃবৃন্দরা। এরপর এমএন লারমা, তাতিন্দ্র লাল চাকমা সহ জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী সকল বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট মৌনব্রত পালন করা হয়।
এছাড়াও স্মরণসভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শ্রী সুনেন্টু চাকমা; ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি শ্রী আম্বেদকর চাকমা; জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমা; জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও ১নং কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান শ্রী সুনীল চাকমা এবং খাগড়াছড়ি সদরের বেতছড়ি এলাকা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাবেক সশস্ত্র আন্দোলনের একজন যোদ্ধা পিযুজ কান্তি চাকমা।
বক্তারা তার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে তাতিন্দ্র লাল চাকমার মত কোন কমান্ডার এতটা সফল হতে পারেনি। তিনিই একমাত্র কমান্ডার যিনি শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে ৪৭ টি আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে এনেছিলেন। তার বিচক্ষণতা, রণকৌশল, নমনীয়তা, শিষ্টাচার ও পার্টির নির্দেশ পালনে বদ্ধ পরিকর থাকায় মহান নেতা এমএন লারমার কাছে বিশ্বস্তটা অর্জন করতে পেরেছিলেন। শ্রী বিভূরঞ্জন চাকমা বলেন- “এমএন লারমা একসময় তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে বলেছিলেন- “তুই নদরাজ নে” (তুমি ভয় পাওনা!), যত কঠিন অপারেশনই হোক না কেন পার্টির নির্দেশ মেনে তিনি কোন দ্বিধা ছাড়াই অপারেশনে চলে যেতেন এবং সফল হতেন। এর কারণেই এমএনলারমা এমন মন্তব্য করেছিলেন।
শ্রী আরাধ্যপাল খীসা বলেন- পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনের সময়ে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিছু অঞ্চল জুড়ে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে। জুম্ম মহাজন, ধনীদের ধনসম্পদ জোরপূর্বক লুটপাট করে গ্রামের সাধারণ মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিতে শুরু করে। এতে দিনদিন জুম্ম সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করতে শুরু করে। এই সর্বহারা পার্টিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তুমুল যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে বিতাড়িত করে শান্তিবাহিনীরা। যার নেতৃত্বে ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে) বা তালুক বাবু। আর এতে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী সহযোগী ছিলেন ক্যা-হ্লাউ ভান্তে।
শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে রাঙ্গামাটির থেগা ও রেঙক্যং ভ্যালিতে আস্তানা গড়ে তুলেছিল কুকি বা মিজো পার্টি। তাঁরা ভারতের মিজোরামে সেখানকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে লুকিয়ে থাকতো। পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে তাঁরা এখানকার মানুষদের উপর নির্যাতন চালাতো, জোরপূর্বক ছাগল, শূকর, কুকুর, মুরগি ধরে নিয়ে রান্না করে খেতো। আর সুযোগ বুঝে শান্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতো। ফলশ্রুতিতে একসময় শান্তিবাহিনীরা মিজো পার্টির উপর আক্রমণে যেতে বাধ্য হয়। বহুবার উক্ত অঞ্চলে মিজো পার্টির সাথে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংঘাত হয়, শান্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে একসময় মিজো পার্টিরা পরাজয় শিকার করে নেয় এবং উক্ত অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রবাদ আছে মিজোরা পরাজয়ের পর মন্তব্য করেছিল- “আমরা মানু মনে করেছিলাম শান্তিবাহিনী আমাদের ছোট ভাই, এখন দেখি শান্তিবাহিনী আমরার ছোট ভাই”। মিজো বাহিনীর সাথে যতগুলো যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা।
বিভূরঞ্জন চাকমা এ প্রসঙ্গে বলেন- “ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর লোকেরা একসময় প্রচুর খোঁজাখোজি করেছিল কে এই কমান্ডার যে কিনা মিজো বাহিনীকে ধূলিস্যাৎ করেছিল এই অঞ্চলে। সাক্ষাতের জন্য তারা প্রচুর খোঁজাখোজি করার পর একসময় খুঁজেও পেয়েছিল। মিজো বাহিনীকে পরাজিত এবং এ অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য করার কারণে তারা তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন। এবং তারা তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে সম্মান জানিয়ে সম্মাননাসূচক পত্রও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে পত্রটিও তাতিন্দ্র লাল চাকমার কাছে পৌঁছার আগেই মান্যবর সন্তু লারমা লুকিয়ে ফেলেন, যা আর কোনদিন দেননি এবং বিষয়টি গোপনই থেকে যায়।”
গোটা পার্টির মধ্যে তিনিই সর্বাধিক সাহসী ও বিচক্ষণ কমান্ডার ছিলেন বলে ধারণা করা যায়। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর এমএন লারমা ও তার সহযোগীদের উপর হত্যাকান্ড চালানোর পর একটি জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল এক সন্তু লারমাকে পার্টির সভাপতি করা, দুই বাদী দলকে দমনের উদ্দেশ্যে একটি ফোর্স গঠন করা যার নাম ছিল DDF । যার উদ্দেশ্য হলো শত্রুদের দমন বা নির্মূল করা। এবং উক্ত ফোর্সের প্রধান ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা। তাকে নিয়েই উক্ত ফোর্সটি গঠন করা হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ কিংবা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশী বিদেশী বিভিন্ন মহল মন্তব্য করেছিল এই গৃহযুদ্ধ থামতে বা বন্ধ হতে সর্বনিম্ন ১০ বছর লেগে যাবে। কিন্তু তাতিন্দ্র লাল চাকমা তার সাহসীকতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা মাত্র দুই বছরে উক্ত গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত করতে সমর্থ হন।
গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরার আগে শ্রী সন্তু লারমা ১২০ জনের একটি তালিকা তাতিন্দ্র লাল চাকমার হাতে তুলে দেন এবং তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু কি কারণে হত্যা করতে হবে এর জবাব দেননি। যতটুকু জানা যায় যাদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারা সকলেই খাগড়াছড়ি হতে পানছড়ি এলাকার গণ্যমান্য ও কার্বারী মুরুব্বীবৃন্দ। হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কারণ ছিল গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা বাদীগ্রুপকে সহযোগীতা করেছে। যখন তাতিন্দ্র লাল চাকমা তালিকাতে চোখ ভুলালেন দেখলেন তার ছাত্র জীবনের সহপাঠি প্রভাত চন্দ্র চাকমার নাম। তিনি মনে মনে ভাবলেন ঠিক আছে নির্দেশ মতে সকলকে আমি হত্যা করলাম কিন্তু আমার সহপাঠিকে কিভাবে হত্যা করবো? পরে চিন্তা করলেন বাকিরাওতো সাধারণ পাবলিক যে সহযোগীতা চাইবে তাকে সহযোগীতা দিতে তারা বাধ্য। তাদের হত্যা করে কি লাভ? পরে তাতিন্দ্র লাল চাকমা হত্যা করবেন না এ কথাও সন্তু লারমাকে জানাননি এবং তিনি হত্যাও করেননি।
শ্রী প্রণব চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটিমাত্র খাঁটি ধানের বীজ হলেন এমএন লারমা সেই বীজ থেকে উৎপন্ন হওয়া খাঁটি চারা গাছদের মধ্যে তাতিন্দ্র লাল চাকমা একজন। আমাদেরকেও এই খাঁটি বীজ ধান হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাঁচে কানাচে ছড়িয়ে পড়তে হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে স্পুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে হবে। তাতিন্দ্র লাল চাকমা একজন প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারকবাহক, প্রগতিশীল চিন্তাধারাই একমাত্র মানুষকে নির্ভুল চিন্তাধারা করতে সাহায্য করে এবং মানব মুক্তির একমাত্র মন্ত্র হচ্ছে এই প্রগতিশীল চিন্তাধারা। প্রগতিশীল চিন্তাধারা লালন এবং অধ্যয়ন অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের সুসজ্জিত করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস, বিভিন্ন দেশের আন্দোলনের ইতিহাস কিংবা প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে কোথায় কি হচ্ছে তা জানতে হলে বই এবং সংবাদপত্রের সাথে মনসংযোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন অধ্যায়নই তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে এতদূর এনেছে। তিনি প্রচুর অধ্যায়ন করতেন এবং তার মত আমাদেরকেও পড়ালেখায় তথা অধ্যায়ন করতে হবে প্রতিনিয়ত।
বক্তারা তাতিন্দ্র লাল চাকমার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের আলোচনা করেন এবং তার সংগ্রামী জীবনের থেকে শিক্ষা নিয়ে জুম্ম জনগণের আগামী দিনের লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। জুম্ম জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে তাতিন্দ্র লাল চাকমারা যেভাবে জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন তাদের সংগ্রামী জীবনের স্মৃতিগুলোকে অনুপ্রেরণা করে তরুণ সমাজ ও ছাত্র সমাজ আগামী দিনের লড়াই সংগ্রাম এগিয়ে নেবে বলে মন্তব্য করেন।
সর্বশেষ যুব সমিতির সভাপতি ও আজকের স্মরণসভার সভাপতি জ্ঞানপ্রিয় চাকমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্মরণসভার সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সভা সমাপ্তি ঘোষণার পর সন্ধ্যা ৭ টায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন কর্মসূচীর ঘোষণা করা হয়।