পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে জনসংহতি সমিতির সংবাদ সম্মেলন

খাগড়াছড়িপার্বত্য চট্টগ্রাম

সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি

সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দ

ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

আজ (৩০ নভেম্বর ২০২১) দুপুর ১২ ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি সদরের মহাজন পাড়াস্থ এফ.এন.এফ রেস্টুরেন্টে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী বিভূ রঞ্জন চাকমা। লিখিত বক্তব্যে শ্রী বিভূ রঞ্জন চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির চব্বিশটি বছর পূর্ণ হতে চলেছে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এই সুদীর্গ সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই তৃতীয়াং ধারাগুলোই অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। আরো অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ২০০৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এক যুগের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আগের মতোই অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরণ এবং উক্ত পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন এর বিধিমালা চূড়ান্তকরণ, আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও তাদের নিজস্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন, অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন, চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশোধন, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সরকার অদ্যাবধি কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান থাকলেও উক্ত পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ(স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নসহ প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর না করায় এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ গড়ে উঠতে পারেনি। এক যুগের অধিক সময় ধরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও পরিষদ সমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং দলীয় ক্ষমতাসীন সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিচালনার ফলে জেলা পরিষদ চরম দুর্নীতি, অনিয়ম ও গণ-বিরোধী আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সংকীর্ণ স্বার্থে শাসকগোষ্ঠীর তাবেদারি ও চুক্তি বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৪ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, “জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসর প্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ল্যান্ড কমিশন” গঠনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি, প্রথা ও পদ্ধতি অনুসারে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা; কিন্তু বিগত ২৪ বছরে একটিও ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিগত ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সরকার ভূমি কমিশনের বিধিমালা ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। উক্ত বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে কমিশনের ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত মামলার বিচারিক কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছেনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সামগ্রিক পরিস্থিতি আজ অত্যন্ত নাজুক। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনো শোষণ, বঞ্চনা, গ্লানি, নিপীড়ন, অবিচার, হতাশা, নিরাশা তথা উগ্রজাতীয়তাবাদ, মৌলবাদ, ইসলামি সম্প্রসারণবাদের প্রতারণা ও বিশেষ মহলের তৎপরতা বহাল তবিয়তে রয়েছে। সাম্প্রতিককালেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর কর্তৃত্ববাদ এবং ভূমি বেদখলের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে। ফলে নিরীহ জুম্ম জনগণ নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশংকায় অনিরাপদ জীবনযাপন করছে, প্রতারিত হচ্ছে, অপমানিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। কখনো কখনো মা-বোনেরা যৌন হয়রানি ও লাঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী যতই দাবী করুক না কেন- তার শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, জনবান্ধব, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নয়নমূখী, কিন্তু বাস্তবে তা সত্য নয় বলে প্রতীয়মান হয়। বস্তুত শাসকগোষ্ঠী চায় পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাক, উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল অ-উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হোক। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে পাহাড়ের বুকে চলছে উপনিবেশিক কায়দায় দমন-পীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা ও অবিচার-অত্যাচার। শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দলীয়করণ, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অসদিচ্ছা, নানা দ্বিধা, অনীহা, বেআইনি অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, মিথ্যা মামলা ও দমন-পীড়নের ফলে আজ জুম্ম জনগণ বিশেষভাবে বিক্ষুব্ধ ও শংকিত।

লিখিত বক্তব্যে শ্রী বিভূ রঞ্জন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৭দফা দাবীনামা তুলে ধরেন। দাবীগুলো হলো-

১) চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নপূর্বক দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা;

২) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কার্যকর রাখা;

৩) চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, স্থানীয় পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার কার্যাবলী ও ক্ষমতা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করা;

৪) চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নপূর্বক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা;

৫) চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাগত জনসংহতি সমিতির সদস্যদের যথাযথ পুনর্বাসন করা;

৬) ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের যথাযথ পুনর্বাসন করা;

৭) পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের আদিবাসীদের জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।

লিখিত বক্তব্যের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্রী সুধাকর ত্রিপুরা। এসময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা কতদূর, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন, স্থানীয় ভোটার তালিকা প্রণয়ন, কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভবসহ ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব দেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী আরাধ্যপাল খীসা, সাধারণ সম্পাদক শ্রী সিন্ধু কুমার চাকমা; পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রীমতি ববিতা চাকমা, সদস্য শ্রীমতি সুস্মিতা চাকমা; পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী রাজ্যময় চাকমা প্রমূখ। এছাড়াও পার্টির কেন্দ্রীয়, জেলা, থানা ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।

নিম্নে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যের কপি সংযুক্ত করা হলো-

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪তম বর্ষপূর্তি আগামীকাল
নানিয়ারচরে যৌথ বাহিনীর অভিযানঃ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu