লংগদুতে বিচারহীন সাম্প্রদায়িক হামলার ৪ বছর আজ

পার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

স্থানীয় জুম্মরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। ছবি- ফেসবুক

রাঙ্গামাটির লংগদুতে বিচারহীন সাম্প্রদায়িক হামলার ৪ বছর আজ। ২০১৭ সালের আজকের দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা মিলে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এ হামলায় প্রায় ৩০০ এর অধিক জুম্ম ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, অসংখ্য ঘরবাড়িতে ও বৌদ্ধ বিহারে লুটপাট-ভাংচুর চালানো হয় এবং গুণবালা চাকমা নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়। ঘটনার ৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও অপরাধীরা আজো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ঘটনার বিবরণঃ ২০১৭ সালের ১লা জুন, বৃহস্পতিবার দুপুরে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ৭নং ইউনিয়ন শাখার যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম নয়ন (৩৫)-এর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ লাশটি উদ্ধার করা হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার চার মাইল এলাকা থেকে। স্থানীয় পুলিশ জানায়, দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যার পর লাশ ফেলে রেখে যায়৷ তিনি একজন ভাড়াটে মোটর সাইকেল চালক ছিলেন বলে জানা যায়। এরপর থেকেই লংগদু উপজেলা সদরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷

২ জুন শুক্রবার সকাল ৮ টার দিকে লাশ লংগদুতে নিয়ে আসা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷ হত্যাকান্ডের দায় ছাপিয়ে দেয়া হয় জুম্মদের উপর। হামলা চালানো হয় জুম্ম জনপদগুলোতে।

ক্ষয়ক্ষতির বিবরণঃ এ হামলায় লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট; মানিকজুরছড়ায় কমপক্ষে ৪০টির অধিক ঘরবাড়ি, এবং বাত্যা পাড়ায় প্রায় ৪০টি ঘরাবাড়িসহ জুম্মদের প্রায় ৩০০টির অধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ছত্রছায়ায় লংগদু উপজেলায় বাত্যা পাড়া থেকে সেটেলার বাঙালিদের এক জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি আনুমানিক ১০টার দিকে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় পৌঁছলে সেটেলার বাঙালিরা কোন উস্কানী ছাড়াই জনসংহতি সমিতির অফিসসহ জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ঘরবাড়ি লুটপাটসহ জুম্মদের উপর হামলা করতে শুরু করে। এতে তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের ২০০-এর অধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয় বলে জানা যায়। এরপর সেনা ও পুলিশ প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী মানিকজুরছড়ায় হামলা করতে যায়। এতে জুম্মদের বসতিতে অগ্নিসংযোগ করলে কমপক্ষে ৪০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। বেলা ১২টার দিকে স্থানীয় প্রশাসন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা দক্ষিণ মানিকজুরছড়া, বাত্যা পাড়া ইত্যাদি জুম্ম গ্রামে অগ্নিসংযোগ করেছিল বলে জানা গেছে। বাত্যা পাড়ায় আরো ৩০টি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়। এ হামলায় গুণবালা চাকমা নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়।

হামলায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অংশগ্রহন

লাশ নিয়ে সেটেলারদের জঙ্গী মিছিল বের করার খবর ১লা জুন বৃহস্পতিবার রাতে জানাজানি হলে স্থানীয় জুম্ম জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দরা লংগদু সেনা জোন ও লংগদু থানা কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার কথা জানান। ২ জুন সকালে লংগদু সেনা জোনের পক্ষ থেকে টুআইসি মেজর রফিক জুম্মদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, “মিছিল করা সেটেলার বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলটি করবে। কোন অঘটন ঘটতে দেয়া হবে না।” তাই নিরাপত্তা নিয়ে জুম্মদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে জুম্ম জনপ্রতিনিধি ও জুম্মদেরকে তিনি আশ্বস্থ করেন। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক যে, লংগদু সেনা জোনের জোন কম্যান্ডার লেঃ কর্ণেল আবদুল আলিম চৌধুরী পিএসসি, টুআইসি মেজর রফিক ও লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা-পুলিশের সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে সেটলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। উক্ত জঙ্গী মিছিল ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পাটি, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি জাতীয় রাজনৈতিক দল দলমত নির্বিশেষে এবং সাম্প্রদায়িক উগ্র সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন ও অন্যান্য সেটেলার বাঙালিদের সংগঠনের লোকজন অংশগ্রহণ করে বলে জানা যায়। সেনা জোন ও থানার পক্ষ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করা সত্ত্বেও এবং তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে জুম্মদের ঘরবাড়িতে সেটেলার বাঙালিদের অবাধে এই অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলার ঘটনা থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সেনা-পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের যোগসাজশে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে সেটেলার বাঙালিরা লাশ নিয়ে মিছিল করার আয়োজন করেছিল। যদিও উক্ত ঘটনায় পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়িগুলো সরকারের পক্ষ থেকে তুলে দেয়া হয়েছিল।

৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া এ হামলায় জড়িত অপরাধীরা আজো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর ৫০টির অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে এবং ১৩টি গণহত্যা চালানো হয়েছে। আজ পর্যন্ত এসব হামলা ও গণহত্যার কোন বিচারই জুম্মরা পাইনি।

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

বর্ষীয়ান পাহাড়ী নেতা সুধাসিন্ধু খীসার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
পানছড়িতে মধ্যরাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপর হামলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu