বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেনের ৮৬তম ফাসিঁর দিবস আজ

জাতীয়

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

মাস্টার দা সূর্যসেন

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বাঙালী বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেনের ৮৬তম ফাসিঁর দিবস আজ। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে তাঁকে বিচারের নামে এক মিথ্যে প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একই সাথে সূর্য সেনের বিশ্বস্ত সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হয়।

দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে উদ্ধারের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবতীর্ণ হয়ে এই বিপ্লবী ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ বিসর্জন দেন।

চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল চারটি। টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ, ভলান্টিয়ার ব্যারাক বা সামরিক অস্ত্রাগার দখল, পুলিশ ব্যারাক ও পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ। এই চারটি লক্ষ্যেই বিপ্লবীরা সফল হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবীরা যোদ্ধা ছিলেন, সন্ত্রাসবাদী নন। সূর্য সেন ও তাঁর সাথিরা নিজেদের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র ‘চট্টগ্রাম শাখা’ বলতে পছন্দ করতেন। সন্ত্রাসকে তাঁরা পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিলেও সন্ত্রাসই তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল ‘জাতীয় সরকার’ গঠন। ১৮ এপ্রিলের সেই রাতে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখলে এনে ‘অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার’-এর নামে তাঁরা আকাশে তিনটি গোলা ছুঁড়লেন এবং বন্দে মাতরম স্লোগান দিলেন। ভারতের সূদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনটি আর কখনোই হয়নি। উপনিবেশ ভারতের মাটিতে একটা জাতীয় সরকার গঠিত হলো। যদিও তার আয়ু ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।

সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন।

তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ-তে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। ফলে, তাঁকে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে যেতে হয়। ১৯১৮ সালে তিনি বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সময় ১৯১৬ সালে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেই সময় বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ কলেজে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে বিপ্লবী ভাবাদর্শে দিক্ষিত হন।

সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী,নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন সূর্য সেন। ঊমা তারা কলেজে শিক্ষকতা করায় তিনি মাস্টারদা নামে পরিচিতি পান।

১৯২০-এ মহাত্মা গান্ধী বিপ্লবীদের কাছে এক বছরের স্বরাজ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এ সময় কলকাতার যুগান্তর দলের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও ইংরেজবিরোধী প্রকাশ্য আন্দোলনে যোগ দেয়। মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তখন সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আবার গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন।

১৯২৩-এ সূর্য সেনের সহযোগীদের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনের অর্থ সংগ্রহের জন্য রেলওয়ের ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করা হয়। এরপর পুলিশ তাদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যা নাগর থানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণ না থাকায় তারা দ্রুত ছাড়া পান। ১৯২৬ সালে টেগার্ট হত্যা চেষ্টার পর তিনি কলকাতায় গ্রেফতার হন। মুক্তি পান ১৯২৮ সালে।

১৯২৯ সালের প্রথম দিকে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় সূর্য সেনের দলের উদ্যোগে চারটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সাল থেকেই তার উদ্যোগে ভবিষ্যৎ সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, রাত ১০টা। কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে মাঠে নামে। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এই দুঃসাহসী কাজের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবের স্বপ্নপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন। এতে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দেড়শ বছরের গৌরব ধুলোয় মিশে যায়। বিপ্লবীদের কাছে ব্রিটিশ আর্মি পরাজিত হয় এবং পিছু হটে। সফল অভিযানের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারি স্যালুট প্রদান করে। আর এ সময় সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন।

সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালে এক বাড়িতে গোপনে অবস্থানের সময় একজন নিকট-আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন তিনি। ১৯৩৩ সালের মার্চে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই ফাঁস হয়ে যায় তাদের গোপন পরিকল্পনা। সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৩৩ সালে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে। ওই একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রতিও প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। কুমারী কল্পনা দত্তকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

সূর্য সেনকে কনডেম সেলে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরিতে রাখা হত। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। ধরে নেওয়া হয় এটি জীবদ্দশায় মাস্টারদার শেষ চিঠি। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তার ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো’।

সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে তৎকালীন ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহের বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন কোনো এক স্থানে ফেলে দেওয়া হয়।

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মহিলা সমিতি’র খাগড়াছড়ি সদর থানা ও জেলা কমিটি’র যৌথ সম্মেলন সম্পন্ন
কুতুকছড়িতে বেইলি ব্রিজ ভেঙ্গে পাথর বোঝাই ট্রাক খালে, নিহত ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu