সুর কৃষ্ণের পেশাদার দিনগুলো ও দীর্ঘশ্বাস

দেশ

ভেনগার্ড ডেস্ক

করোনায় বক্সিং রিংয়ে তেমন কারো আর আনাগোনা নেই। ডরমিটরিটায় সুর কৃষ্ণ চাকমা একাই থাকেন। সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রানিং-স্ট্রেচিং করেন, এরপর যতটা পারেন অনুশীলনে সময় কাটান। একা একাই। পাঞ্চিং প্যাডগুলোকে অদৃশ্য কোনো প্রতিপক্ষ বানিয়ে একের এক ঘুষি ছোড়েন। অ্যাটাক, ব্লক, পুল… মনে মনে আউড়ে যান, সাপের মতো শরীরটা পাক খায়।

রাঙামাটির জুরাছড়িতে অলস বসে বসে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন এই বক্সার। অনুশীলনে ফেরা শুধু সে কারণেই নয়। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, এসএ গেমস কিংবা অলিম্পিকও না, সুর কৃষ্ণের মনের ভেতর বাসা বেঁধেছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন, সেটা পেশাদার বক্সিংয়ে। পল্টন মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের পাশে দেখা হতেই বললেন, ‘অনুশীলনটা আবার শুরু করে দিলাম। আমাদের এখানে কবে কী হবে তো ঠিক নেই। ওদিকে আবার আমার প্রমোটার যদি ডাকেন…।’ সুর কৃষ্ণের বক্সিং প্রমোটার আলী জ্যাকো। কিক বক্সিংয়ের দুইবারের চ্যাম্পিয়ন সিলেটের এই জ্যাকোই তাঁকে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নটা বুনে দিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের জমিন ছাড়িয়ে এখন যদিও অনেক দূরে ছিটকে গেছেন সুর, তবু দেশের প্রথম পেশাদার বক্সার হিসেবে নাম উঠেছে তাঁর। ক্যারিয়ারে মাত্র দুটি ‘ফাইট’ করেছেন, ভারতের হরিয়ানায় সেই দুটি লড়াইই জিতেছিলেন, কিন্তু ২০১৮ সালে জেতা ওই দুটি লড়াইই তাঁর পেশাদার বক্সিংয়ের শেষ কি না সুর জানেন না।

আলী জ্যাকোর মাধ্যমে লন্ডনের বিখ্যাত পিকক জিমে ছয় মাস অনুশীলন করেছিলেন সুর। পেশাদার বক্সার হিসেবে তাঁর তৈরি হওয়ার দিন ছিল সেগুলো। এখনো ভাবলে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে মধুর সময় বলেই মনে হয় তা, ‘আমি অল্প কয়েক দিনেই ওখানে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। অনেক নামকরা বক্সার আসত সেখানে। আমি যাদের সঙ্গে অনুশীলন করেছিলাম, তারা এত দিনে পেশাদার সার্কিটে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ ওরা সবাই বলত, আমি খুব দ্রুত ওপরে উঠতে পারব। অনুশীলনে যে কটি ফাইট করেছিলাম, প্রতিটিতেই ভীষণ প্রশংসা। কিন্তু আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল। জ্যাকো বলেছিলেন, দেশে ফিরে আবার নতুন করে করিয়ে নিতে। কিন্তু সেই যে ফিরলাম আর যাওয়া হয়নি।’ তার জন্য জ্যাকোকেও দোষী করেন না সুর, ‘উনি আসলে অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ওই সময়টায় মিউজিক ভিডিও নিয়ে মেতে ছিলেন। দেশে ফিরে কয়েকবার যোগাযোগ করলে বলেন, অপেক্ষা করো। পরে একটা সময় ফোনও ধরছিলেন না। আমি পরে আশা ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।’

দেশে জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে একরকম চুরি করে জ্যাকোর সঙ্গে লন্ডনে গিয়েছিলেন সুর। জ্যাকো আরো বেশ কয়েকজন বক্সারকে নিতে চেয়েছিলেন, ছয়জনকে বাছাই করেছিলেন। কিন্তু তখনকার ফেডারেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা বেধে যায়, ফেডারেশন সম্পাদক মোহাম্মদ কুদ্দুস তাঁর বিরুদ্ধে আদমপাচারের অভিযোগ আনেন। জ্যাকো পরে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছিলেন। পরে শুধু সুরই তাঁর সঙ্গী হন। সুর বিকেএসপি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। জ্যাকোর সঙ্গে যাওয়ায় পরে যখন জাতীয় দলেও আর ফিরতে পারছিলেন না তিনি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়েই পুরোপুরি মন দেন। আন্ত হল, আন্ত বিভাগ খেলায় নিয়মিত হয়ে ওঠেন। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে লন্ডন থেকে ফেরার দুই বছর পর আবার জ্যাকোর কল পান তিনি। জ্যাকোই তাঁকে ভারতে গিয়ে পেশাদার লাইসেন্স নিতে বলেন, কোথায় কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে বলে দেন। সেই মতোই সব কিছু করে হরিয়ানায় প্রথম পেশাদার লড়াইয়েও নেমে যান সুর, ‘একটা খোলা মাঠের মধ্যে রিং করা হয়েছিল। দর্শক হয়েছিল অনেক। অন্য বক্সারদের সঙ্গে আমার ছবি দিয়ে পোস্টার করা হয়েছিল। সে এক অন্য রকম উন্মাদনা, উত্তেজনা।’

ভারতীয় বক্সার আশীষ বর্মণের বিপক্ষে ওই অভিষেক লড়াইটাই জিতে যান সুর। এর দুই মাস পর হরিয়ানার কার্নালেই দ্বিতীয় ফাইট জেতেন। ওখানে প্রো-বক্সারদের একটা একাডেমিতে ছিলেন। কিন্তু দেশে ফেরার পর আবার সেই জ্যাকোর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা। কবে আবার তাঁর কল পাবেন, আদৌ পাবেন কি না জানেন না। আবার ভাবেন, পেশাদার বক্সার হিসেবে তাঁর প্রফাইল যেহেতু হয়ে গেছে, হয়তো অন্য কোথাও থেকেও ডাক আসতে পারে। তাই একা একাই লড়াই চালিয়ে যান অদৃশ্য প্রতিপক্ষের দিকে আগুনে দৃষ্টি হেনে, যে আগুনের নিচে বড় একটা স্বপ্নও চাপা পড়ে আছে তাঁর।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মহালছড়িতে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু।
তাইওয়ানে হামলার প্রস্তুতি চীনের

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu