প্রতিভাস চাকমা
মোটামুটি ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত নেশা জাতীয় কোন কিছুর সাথে সখ্যতা ছিল না৷ এর পরবর্তীতে এমন সময় গিয়েছে সন্ধ্যা নামলে আমাদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না, শুধু আমরা যারা নিয়মিত মেলামেশা করতাম আমরা জানতাম কোথায় গেলে আমাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে৷ ঢাকাতে যখন ছিলাম প্রথম কয়েকটা বছর সেভাবেই কেটে গিয়েছিল। বন্ধু-বান্ধবের অভাব ছিল না৷ আজ এর বাড়িতে তো কাল ওর বাড়িতে দাওয়াত থাকতো। সময়টাকে মোটাদাগে ২০০৫-১০ পর্যন্ত বলা যায়।
আমার আজকের এই অবস্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল – ২০০৯ সাল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির এক ভিন্ন বাস্তবতার কারণে রাঙামাত্তে থেকে দুজন বন্ধু ঢাকাতে এসেছিল। সেদিন ঢাকাস্থ মগবাজারে বেশ জমজমাট আসর বসলো। এক পর্যায়ে তাদের কথায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে এই পথে আসা, একসাথে পথচলার শুরু। তখনও রাজনীতির অ, আ, ক, খ কিছুই বুঝতাম না। একটা পর্যায়ে ঢাকা মহানগর কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে সম্মেলনের আগের দিন হাগাড়াছড়ি থেকে বেশ কজন প্রতিনিধি গিয়েছিলেন৷ তার মধ্যে দীর্ঘ দা ছিলেন অন্যতম। অবিভক্ত জেএসএস থাকাকালীন প্রায়শ আমাদের বাড়িতে যেতেন। বাবা আর তিনি একসাথে অফিসে যাওয়া আসা করতেন। সে হিসেবে পরিচয় থাকলেও সেভাবে রাজনৈতিক আলাপচারিতা হয়ে ওঠেনি। সেবারই শুরু। এভাবে মহানগরে বিবিধ কার্যাবলী সম্পাদনসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন কাজে ঢাকাতে যেতেন, দেখা হতো, কথা হতো।
এখনকারমত উবার তখন ছিল না, সে সময়ে মধ্যবিত্তের সৌখিনতা বলতে রিকশা, সিএনজি, টেক্সিক্যাব। অন্যান্য অনেকে সিএনজি বা টেক্সিক্যাবে যাতায়াত করতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখেছি৷ কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি গেলে আমরা যাতায়াত করতাম লোকাল বাসে। একদিন লোকাল বাসে মিরপুর ফিরছিলাম। হঠাৎ বললেন প্রতিভাস আমরা যে কাজে নেমেছি, যে পথে হাটছি এখানে নেতৃত্ব দিতে গেলে প্রথমেই নিজের খারাপ অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে হয়। তোমারও যদি ইচ্ছা থাকে তোমাকে সেগুলো পরিত্যাগ করতে হবে।
খুব ছোট্ট কয়েকটি বাক্য। এত বছর ধরে কতবার বাবা- মা’র কাছে ধরা পড়েছি, কত শত শাসন সত্ত্বেও পরিবর্তন হতে পারিনি – এই কয়েকটি বাক্য আমাকে গভীরভাবে ভাবতে এবং অনুধাবন করতে শিখিয়েছিল।
এক বাক্যে যদি সেটি বর্ণনা করতে বলা হয় তাহলে বলতে হয় – তিনি পালস বুঝতেন। যা আমার সমসাময়িক সকলেই হয়তো স্বীকার করবেন। উনার বক্তব্যে শত শত ছাত্র-যুবক উদ্ভুদ্ধ হয়ে ছাত্র সংগঠনে নাম লিখিয়েছিলেন সে সময়ে। প্রায় শুন্য থেকে যে সংগঠনের নব উদ্যোমে পথচলা শুরু তার সহযাত্রী আমরা। যেহেতু নতুন চালে পুরনো ধাচের রাধুনি তথাপিও তিনি পিছুপা না হয়ে শক্ত হাতে ধীরে ধীরে ছাত্র নেতৃত্বকে সাজানোর প্রচেষ্টারত ছিলেন তিনি আজীবন। তিনি খুব সাদামাটাভাবে যেমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তেমনি অল্প অর্থ ব্যয় করে অধিকতর গুণগত একটি সাংগঠনিক কাঠামো নির্মাণ করার অগ্রসৈনিকের দায়িত্বরত ছিলেন। সম সাময়িক বা সিনিয়র অনেকেই ছিলেন কিন্তু একমাত্র দীর্ঘ দা গভীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থেকে ছাত্র নেতৃত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা দি’দের আমরা দেখিনি। হয়তো মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাথে দীর্ঘ দা’র তুলনা চলে না৷ কিন্তু আমরা গর্বিত দীর্ঘ মত একজন উদীয়মান নেতার নেতৃত্বে আমাদের আন্দোলনে পথচলার রচিত বীজ রচিত হয়েছিল৷
কত শত নেতা প্রতিনিয়ত নিহত, আহত হয়েছেন, হচ্ছেন৷ কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া – মত, পথ ভিন্ন সকলের কাছেই তিনি সমভাবে গ্রহণযোগ্য, শিক্ষণীয় একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করতে পেরেছিলেন।
জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ সুদীর্ঘ চাকমা’দের অবদান অনস্বীকার্য। নির্বোধ ঘাতকের বুলেট তাঁদের প্রাণ নিতে পারে কিন্তু তাঁদের চেতনা চির অমর।
প্রতিভাস চাকমা, সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।