সন্তু লারমা নিরস্ত্র মানুষ হত্যার রাজনীতি কতদিন চালাবেন?

মতামত

জুপিটার চাকমা

গতকাল মঙ্গলবার বাঘাইছড়ির বাবুপাড়াতে গুলি করে হত্যা করা হলো উদীয়মান এক জুম্ম তরুণ সম্ভাবনাময়ী ও মেধাবী ছাত্র রত্ন সাগর চাকমা (২০) কে। তিনি জেএসএস (এমএন লারমা) সমর্থিত পার্বত্য চট্রগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কাচালং সরকারি কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে আমার পরিচয় নেই। তবে আদর্শিক সম্পর্কে আত্মার বন্ধন রয়েছে। তিনি শহীদ হওয়ার পর তার সম্পর্কে বাঘাইছড়ির পিসিপি নেতাদের কাছ থেকে খবর নিলাম। ছেলেটি অত্যান্ত মেধাবী। একজন সু-বক্তা। যে কোন বিষয় দ্রুত আয়ত্ব করার বিষয়ে রয়েছে প্রচুর জ্ঞান।

খেদারমারা ইউনিয়নের পানি ব্যষ্টিত হিরাচর গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দুই ভাই, তিন বোনসহ মোট পাঁচ ভাই বোনের মধ্য রত্ন সাগর চাকমা চতুর্থ। বাবা মা নিয়ে পরিবারের সাত সদস্যর সংসার। ভাই বোনের মধ্য সবার বড় বোনটির বিয়ে হয়েছে আগে। তারপরের দ্বিতীয় ভাইটি চট্রগ্রামের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। তিন নম্বর বোনটির পঞ্চ ইন্দ্রীয় অচল (মানসিক ভারসাম্যহীন)। চতুর্থটি রত্ন সাগর চাকমা। আর সবার ছোট পাঁচ নম্বর বোনটি এবার এসএসসি পাশ করেছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবার উপার্জন বলতে মৎস্য শিকার আর টাকার বিনিময়ে অন্যর কাছে কাজ (দিনমজুর) করা। তার মাও মানসিক ভারসাম্যহীন। বলতে গেলে পরিবারে অনেকটা দৈন্যদশা। এ অবস্থায় রত্ন সাগর চাকমা কোন মতে শিজক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। এরপর আর্থিক দৈন্যতার কারণে কলেজে ভর্তি হতে পারাতো দূরের কথা, চিরতরে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময়ে রত্ন সাগর চাকমার যোগাযোগ হয় বাঘাইছড়ির পিসিপি নেতা জগদীশ চাকমা’র সাথে। রত্ন সাগর চাকমার এমন করুন অবস্থার কথা জানতে পেরে তাকে কাচালং কলেজে পড়ালেখা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন পিসিপি নেতা জগদীশ। লেখাপড়ার সমস্ত খরচাপাতি পিসিপিই বহন করতো। চলতি বছর তিনি আই এ পাশ করেন। কথা ছিল খাগড়াছড়ি বা চট্রগ্রামে কোন এক কলেজে ভর্তির চেষ্টা চালাবে। তাই ভর্তির প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে অবসর সময় পেলেই পত্রিকা আর বিভিন্ন বই নিয়ে পিসিপি মেসের এক কোনায় নিরবে পড়ে থাকে।

অন্য সাধারণ ছাত্রদের তুলনায় মেস থেকে বের হতো খুব কম। পিসিপির কোন কর্মসূচী ছাড়া অহেতুক কোথাও যেত না। বাঘাইছড়ি জেএসএসের (এমএন লারমা) পূর্ব নির্ধারিত ইউনিয়ন ভিত্তিক সাংগঠনিক মিটিঙয়ের কর্মসূচী চলমান থাকায় গতকাল খেদারমারা ইউনিয়নের মুরুব্বীদের সাথে নির্ধারিত মতবিনিময়সভা ছিল। জেএসএস ও পিসিপির সিনিয়র নেতারা এ মিটিঙয়ে যাওয়ার সুযোগে গতকাল বেলা ১ ঘটিকা সময়ে পাশের দোকানে চা খেতে যায় রত্ন সাগর চাকমা। তার দোকানে যাওয়ার খবরটি হত্যাকারীরা সোর্স মারফট জানতে পেরে তালুকদার পাড়ার দিক থেকে দুটি মোটর সাইকেলে করে এসে অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে রত্ন সাগর চাকমাকে খুব কাছে থেকে গুলি করে চলে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন যে, হত্যাকারীরা সন্তু লারমা সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য। ঘটনার কিছু সময় আগেও বাবুপাড়ার পাশের গ্রাম তালুকদারপাড়াতে ৮/১০ জনের একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ ছিল। সেখান থেকেই তারা মোটর সাইকেলে করে এসে গুলি করে।

পিসিপি কর্মী রত্ন সাগর চাকমা নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন উপজেলা ও জেলায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতা কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা তৎক্ষনাৎ পিসিপি কর্মী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। বিভিন্ন জায়গায় হওয়া প্রতিবাদ সভাতে এ হত্যাকান্ডের জন্য সন্তু লারমাকে দায়ি করা হয়। সেখানে বলা হয়, রত্ন সাগর চাকমা একজন ছাত্র। সে জুম্মজাতির তরুণ প্রজন্মের একজন। এছাড়াও একজন পিসিপি কর্মী। দলীয় কর্মী হলেও নিরীহ একজন নিরস্ত্র পিসিপি কর্মী মাত্র। কেন তাকে হত্যার জন্য টার্গেট করা হবে। কেন তাকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হবে। নিরস্ত্র পিসিপি কর্মীকে গুলিতে হত্যা করে সন্তু লারমা সমর্থিত জেএসএস কোন রাজনৈতিক আদর্শের কি ইঙ্গিত দিতে চাই?

তাই বিভিন্ন জায়গায় হওয়া প্রতিবাদসভা থেকে বক্তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, সন্তু লারমা নিরস্ত্র মানুষ হত্যার রাজনীতি আর কতদিন চালাবে ? পিসিপি কর্মী রত্ন সাগর চাকমাকে হত্যার পর সুশীল সমাজের মাঝে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, একজন ছাত্র ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার কারণে সন্তু লারমা ও তার সমর্থিত জেএসএস যে কতটুকু আদর্শহীন হয়ে পড়েছে তা এ ঘটনায় অনুমেয়। সন্তু লারমা পার্বত্য চট্রাগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে দাবী না করে শুধুমাত্র নিরস্ত্র ও সম্ভাবনাময়ী জুম্ম তরুণ ছাত্রদের হত্যা করেই চলেছেন।

রত্ন সাগরের গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতমঃ

রত্ন সাগর চাকমা খুন হওয়ার খবর হিরাচর গ্রামে পৌঁছলে শোকের ছায়া নেমে আসে। রত্ন আর নেই এ খবরটি বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই মানসিক ভারসাম্যহীন মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বাবা হয়ে পড়েছেন বাকরুদ্ধ। ভাই বোনের কান্না। কেউ কেউ বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। গ্রামবাসীরা সেখানে গিয়ে সান্তনা দিচ্ছেন আর রত্নের বাবা, মা’র মাথায় পানি ঢালছেন। বাকরুদ্ধ রত্ন সাগরের বাবা আক্ষেপ করে বিলাপ করছেন, আমার ছেলের কি দোষ? রত্ন বাবুপাড়াতে গিয়ে লেখাপড়া করছে। তাকে পড়ানোর খরচপাতি জোগান দেয়ার মত সামর্থ্য আমার না থাকার দরুণ পিসিপি করেই লেখাপড়া করছে। আমার সমস্ত আশা ভরসার আশ্রয়স্থল ছিল রত্নকে নিয়েই। এ রত্নকেও বাঁচতে দিলনা সন্তু লারমা। আমরা এখন কাকে নিয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবো?

জুপিটার চাকমা , স্টাফ সদস্য, তথ্য ও প্রচার বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি।

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

রত্ন চাকমা’কে হত্যার প্রতিবাদে মহালছড়িতে পিসিপি’র বিক্ষোভ
ছাত্রনেতা হত্যার প্রতিবাদে পিসিপি’র বিক্ষোভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu