খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
“যারা মরতে জানে, পৃথিবীতে তারা অজেয়। যে জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে জানে না সে জাতির বেঁচে থাকার কোন অধিকার থাকতে পারে না” এই স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির উদ্যোগে জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবসে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়ি সদরে দিবসটি পালিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে সকাল ৭টায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অংশুমান চাকমার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি সদরস্থ সুর্য্য শিখা ক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে এম এন লারমা ভাস্কর্য্য পাদদেশ পর্যন্ত প্রভাতফেরীর মাধ্যমে শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের সকল শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়াও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), কেন্দ্রীয় কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি, খাগড়াছড়ি সদর থানা, পৌর কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, যুব সমিতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, জুম্ম শরনার্থী কল্যাণ সমিতি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
পরবর্তীতে, সংগঠনটির সদর থানা কমিটির উদ্যোগে সকাল ১০ ঘটিকায় তেতুলতলা মিলনায়তনে দিবসটিকে কেন্দ্র করে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। স্মরণসভায় সুনীল চাকমা সভাপতিত্বে এবং ভলাস ত্রিপুরার সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অংশুমান চাকমা। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ইন্দু বিকাশ কার্বারী, ধীমান খীসা, প্রিয় কুমার চাকমা, রবি শংকর চাকমা, কবি ও লেখক বিনয় শংকর চাকমা, শরনার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা (বকুল), হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মায়া চৌধুরী, জেএসএস খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক প্রীতি খীসা, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অমর জ্যোতি চাকমা প্রমুখ।
স্মরণসভার শুরুতে সুশীল চাকমার শোক প্রস্তাব পাঠ করার মধ্য দিয়ে শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে ১মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা হচ্ছেন- সামন্তীয় সমাজ ব্যবস্থায় গোষ্ঠীবাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দশ ভাষাভাষী ১১টি জাতিকে জুম্মজাতীয়তাবাদের পতাকাতলে একত্রিত করার মাধ্যমে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানোর অগ্রদূত। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চির নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি শুধুমাত্র জুম্ম জনগণের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন না, সোচ্চার ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে মেহনতি মানুষের কথা, শোষণহীন সমাজের বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবী জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাঁর এই দাবী সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়নি, যেকারণে ‘৭১ সালে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণ তা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও পূরণ হয়নি। তাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে গঠিত অর্ন্তবর্তী সরকার যে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেই সংবিধানে এম এন লারমার সেই সময়ের সংসদ বক্তব্য, দাবীগুলোর প্রাধান্য দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
বক্তারা আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে যে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে জুম্ম জনগণের মাঝেও আশার সঞ্চার করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণও বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলের মত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে জীবন-ধারণ করতে পারবে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসেও জুম্ম জনগণের অধিকারের প্রশ্নে এই সরকারকে আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি, উপরন্তু সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিগত সময়ের মত একই কায়দায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার সম্মুখিন হতে হয়েছে, জেলা পরিষদে অযোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন করা হয়েছে। বক্তারা অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবী জানান।
শহীদদের স্মরণে সন্ধ্যা ৬টায় এম এন লারমা ভাস্কর্য্য পাদদেশ, খাগড়াছড়ি সদরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উড়ানোর মাধ্যমে দিবসটির কর্মসূচির সমাপ্ত হয়।