সিএইচটি ভ্যানগার্ড ডেস্ক
রক্তিম চাকমা
১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। প্রতিষ্ঠার পর হতে জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসের স্তম্ভ হয়ে আজো তার স্বমহিমায় টিকে রয়েছে জনসংহতি সমিতি। সংগঠনের ৫১টি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, এই ৫১টি বছরে কত ত্যাগ কত তাজা প্রাণ নিস্তেজ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক, আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সর্বোপরি এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয় আলাদা হওয়ায় এখানকার জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ সংরক্ষণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জুম্ম নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরপর নেতৃবৃন্দের পরামর্শে এমএনলারমা ও জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা প্রবীণ নেতা ও ১৯৫৬ সালে গঠিত হওয়া “পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির” প্রাক্তন সভাপতি কামীনি মোহন দেওয়ানের কাছে যান। কামিনী মোহন দেওয়ান জানান পাকিস্তান সরকার তাদের সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে, সুতরাং এ নামে আর সংগঠন করা সম্ভব নয়। ফলে ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এমএনলারমার নেতৃত্বে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির” নাম সামান্য পরিবর্তন করে রাঙ্গামাটিতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” গঠন করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যার কারণে এমএনলারমসহ অনেক পাহাড়ী যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেয়া হয়নি। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় এ অঞ্চলের পাহাড়ীদের ভারতপন্থী আখ্যা দিয়ে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর আখ্যা দেয়া হলো পাকিস্তানপন্থী। প্রতিনিয়ত পাহাড়ীদের উপর চলতে থাকে স্টিম রোলার, বিডিআর, পুলিশ, সেনাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশী, রাজাকারের নাম দিয়ে গ্রেফতার, লুটপাত, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদিভাবে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল পাহাড়ী মানুষদের উপর । এভাবে বঙ্গবন্ধুর পাহাড়ী মানুষদের দাবী প্রত্যাখান ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হলে এখানকার পাহাড়ী মানুষেরা অনিয়মতান্ত্রিক পন্থার দিকে এগোতে বাধ্য হয়। সামাজিক অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের উপযুক্ত প্রতিকার ও ন্যায়বিচার না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্থ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, শান্তি ফিরিয়ে আনা ও সামজিক অনাচার প্রতিরোধ, সর্বোপরি জাতিগত নিপীড়ন প্রতিরোধের মানসিকতা থেকেই ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি জনসংহতি সমিতি’র সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী (Peace Force) জন্ম লাভ করে।
১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে এক নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, “জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের আমরা সবাই বাঙালী” বঙ্গবন্ধু বাঙালী ব্যতিত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু পাহাড়ীদের বৃহত্তর বাঙালীদের সাথে মিশে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের প্রধানের কাছে এর চাইতে হতাশাজনক বাক্য আর কি হতে পারে! ফলশ্রুতিতে এমএনলারমা জুম্ম জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে এ অঞ্চলের পাহাড়ী মানুষদের এককাতারে নিয়ে আসেন। তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল জুম চাষ, এই অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে এই জুম্ম জাতীয়তাবাদ । পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বাঙালী জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এই চিন্তা ভাবনা নিয়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসনে এমএনলারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম-২ আসনে চাইথোয়াই রোয়াজাকে বিপুল ভোটে জয়ী করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের জনগণ। ১৯৭৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলাদেশ একভাষা ও এক সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র”- এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হলে এমএনলারমা এর প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি বাংলাদেশী, কিন্তু আমার একটি আলাদা সত্ত্বা আছে, সেখানে আমি চাকমা, বাঙালি নই। “১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধানের উপর এমএনলারমা বলেন, “এ সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কথা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমল হতে নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, আমাদের জাতিসত্ত্বার কথা ভুলে যাওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা বাংলাদেশের মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে বসবাস করতে চাই। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতিসত্তার স্বীকৃতি রয়েছে। আমি সংবিধানে উপজাতীয় জনগণের অধিকার স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারের হত্যার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার কারণে এমএনলারমা আত্মগোপন করেন এবং জনসংহতি সমিতিকে সুসংহত করতে শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের ভেতর জনসংহতি সমিতি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধিদল এ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও এ সমস্যাকে একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। যার কারণে জিয়াউর রহমান এ অঞ্চলের সমস্যাকে নিরসণে কালক্ষেপনের নীতি গ্রহণ করেন। ফলে জনসংহতি সমিতি ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর প্রথম সশস্ত্র আক্রমণে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে নিয়মিত সংঘর্ষে সরকারি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। শান্তিবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময়ই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আটক হন শান্তিবাহিনীর উত্তরাঞ্চলের বিগ্রেডিয়ার ও ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা এবং দক্ষিণাঞ্চলের ব্রিগেডিয়ার ও জেএসএস নেতা চাবাই মগ ।
১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর পার্টির ভিন্নমতাবলম্বী বিভেদপন্থীদের আক্রমণে নির্মম্ভাবে শহীদ হন জাতীয় চেতনার অগ্রদূত ও জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এমএনলারমা। এরপর সংগঠনের হাল ধরেন এমএনলারম ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু)। পার্টি প্রতিষ্ঠার পর হতে দীর্ঘ ২৫টি বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে জনসংহতি সমিতি। এরপর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হয় জনসংহতি সমিতি। অবসান ঘটে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের সুদীর্ঘ ২৫ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের। আজকে চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো আজো অবাস্তবায়িত রয়েছে। যার ফলে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল সে আশা-আকাঙ্ক্ষা আশার গুড়োবালিতে পরিণত হয়েছে।
জনসংহতি সমিতির চুক্তি পূর্ববর্তী ২৫ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম ও চুক্তি পরবর্তী ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জুম্ম জনগণ কত ত্যাগ স্বীকার করেছে তা বলে শেষ করা যাবেনা। কেউ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, কেউ শত্রু বাহিনীর শক্ত প্রাচীরে সজোরে আঘাত করেছে, কেউবা হারিয়েছে স্বামী, কেউবা হয়েছে অনাথ, কেউবা হারিয়েছে সম্ভ্রম তার ইয়ত্তা নেই। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হাজার হাজার জুম্ম জনগণ নিজেদের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছে। সেটেলার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে হাজার হাজার জুম্ম নর-নারী ভিটেমাটি ছেড়ে পাশ্ববর্তী দেশে শরনার্থী হয়ে দীর্ঘ ১২-১৫ বছর মানবেতর জীবন যাপন করেছে। এতকিছু ত্যাগের পেছনে ছিল শুধু একটাই কারণ এদেশের সংবিধানে তাদের একটু ঠাঁই, তাদের মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সংবিধানে একটু স্বীকৃতি। দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার মানুষদের সাথে তারা যাতে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে সে চাওয়াটাই তাদের ছিল।
জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের আন্দোলনের এই ৫১টি বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল এসেছে, বিভিন্ন কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু জুম্ম জনগণ “জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার” যে মূল্য লক্ষ্য বা চূড়ান্ত লক্ষ্য বা রণনীতি তার একচুলও এখনো পর্যন্ত পরিবর্তন ঘটেনি। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে জেলা পরিষদ হয়েছে, আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে, মন্ত্রণালয় হয়েছে কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছেনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা ফলশ্রুতিতে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার যে উদ্দেশ্য-লক্ষ্য রয়েছে সেখানেই এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে জুম্ম জনগণ।
শুরু থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে নীল নকশা তথা জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের যে ষড়যন্ত্র তা এখন দিনে দিনে প্রবলভাবে চালিত করা হচ্ছে। জুম্ম জনগণের মাঝে নামে বেনামে নানা সশস্ত্র সংগঠনের উদ্ভব ঘটিয়ে জুম্ম দিয়ে জুম্ম হত্যার হীন ষড়যন্ত্র জারি রেখেছে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র। ফলশ্রুতিতে জুম্ম জনগণের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন তথা জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জনসংহতি সমিতির অনেক সোনালী অতীত রয়েছে, আন্দোলনের অনেক ইতিহাস রয়েছে কিন্তু জনসংহতি সমিতির ৫১ বছরের এ যাত্রায় জুম্ম জনগণ কি পেয়েছে। আমরা যেখানে শুরু করেছিলাম অর্থাৎ জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন এখনো সেখানেই আটকে রয়েছি, এই রণনীতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই আমি আবারো বলতে চাই “শুরুতেই এখনো আটকে রয়েছে জুম্ম জনগণ!”