শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রামমতামত

সিএইচটি ভ্যানগার্ড ডেস্ক

শান্তিবাহিনী

লেখক- পেদেলা চাঙমা

১৯৭৩ সালের ০৭ জানুয়ারি জন্ম লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের একমাত্র সশস্ত্র সংগঠন “শান্তিবাহিনী”। শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল ৭ জানুয়ারি ২০২৩।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হলে সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীর জন্ম হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সামাজিক অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের উপযুক্ত প্রতিকার না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্থ জুম্ম জনগণ আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, শান্তি ফিরিয়ে আনা ও সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ, সর্বোপরি জাতিগত নিপীড়ন প্রতিরোধের মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় শান্তিবাহিনী বা Peace Force। পরবর্তীতে শান্তিবাহিনী জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায়।

শান্তিবাহিনী জন্মের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক আইন-শৃঙ্খলার অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। জনসংহতি সমিতির গ্রাম পর্যায়ের রাজনৈতিক সংগঠন গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে শান্তিবাহিনী চুরি, ডাকাতি, সামাজিক অনাচার ও মাদকাসক্তিজনিত সমস্যা কঠোর হস্তে দমন করে। ১৯৭৫ সালের আগে শান্তিবাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা সেটেলার বাঙালিদের উপর কোন আক্রমণ করেনি, শুধুমাত্র বিডিআর ও পুলিশের অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিরোধ ছাড়া। বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার বাট্টি (গোপন নাম) নামক স্থানে স্থাপন করা হয় শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতির প্রধান কার্যালয়। সদর দফতর এলাকাকে বিশেষ সেক্টর করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ছয়টি সামরিক সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরকে ৪টি জোনে ভাগ করা হয়। আবার প্রতিটি জোনকে ভাগ করা কয়েকটি সাব জোন-এ। ১৯৭৩-৭৪ সাল ছিলো শান্তিবাহিনীর রিক্রুটিংয়ের সময়। এসময় হাজার হাজার যুবককে শান্তিবাহিনীতে ভর্তি করানো হয়, তা ছাড়া গ্রামে গ্রামে ‘মিলিশিয়ো’দেরও ট্রেনিং দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই শান্তিবাহিনী গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে।

জিয়া সরকারের আমলে চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে জুম্মদের একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানকল্পে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দরা ভাবতে থাকেন যে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে কোন মূল্যই দেয়া হচ্ছেনা, টাকা দিয়ে তাদেরকে বশীভূত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক দাবীকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে জিয়া সরকার ক্ষালক্ষেপনের নীতি গ্রহণ করায়, ১৯৭৬ সালে শান্তবাহিনী প্রথম সশস্ত্র এ্যাকশনে যায়। জিয়া সরকার এই বিদ্রোহকে সামরিক পন্থায় দমনের চেষ্টা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই ৫বছরে নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রাষ্ট্রীয়বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়। এই সময়েই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আটক হন জেএসএস নেতা ও শান্তিবাহিনীর উত্তরাঞ্চলের ব্রিগেডিয়ার ও ফিল্ড কমান্ডার জেবি লারমা(সন্তু), দক্ষিণাঞ্চলের ব্রিগেডিয়ার ও জেএসএস নেতা চাবাই মগ। পর্দার আড়ালে রাষ্ট্রীয়বাহিনী শান্তিবাহিনীর কাছে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার হলে রাষ্ট্রীয়বাহিনী প্রবলভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর সামরিক সমাধানের আশা ছেড়ে দেন। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হয় শান্তিবাহিনী নির্মূলের জন্য ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান নতুবা রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দেন। কিন্তু জিয়া দু’টির কোনটিই গ্রহণ করেননি। উল্টো ১৯৮০ সালে সামরিক সমাধানের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাকে “উপদ্রুত এলাকা” হিসেবে সংসদে বিল আনেন। কিন্তু বিরোধী দলের প্রবল আপত্তির মুখে জিয়া সরকার তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে সামরিক বিদ্রোহে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি বড় বিষয় বলে জাপানের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘আশাহি শিম্বুন’ লিখেছিল। জানা যায়, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে মঞ্জুরের উত্তপ্ত বিতর্কে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা” গুরুত্ব পায়। সন্তু লারমা জেলবন্দি অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানকল্পে রাষ্ট্রীয়বাহিনীর কাছে দেয়া ৪৩পৃষ্ঠার সুপারিশনামা ও রাজনৈতিক উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সন্তু লারমা ও মেজর মঞ্জুরের সাথে আলোচনা হয়।

শান্তিবাহিনীর তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ইতিহাসে ৮৩’র গৃহযুদ্ধ একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৯৮২ সালের (২৪-২৭) সেপ্টেম্বর জেএসএসের ২য় কংগ্রেসে প্রথম ভোটের মাধ্যমে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সশস্ত্রপন্থায় প্রথম ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চলে। ভবতোষ দেওয়ান-প্রীতিকুমাররা কংগ্রেসে বিরোধীতা না করলেও কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে গোপনে ৯ সদস্যক আরেকটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে। যার ফলশ্রুতিতে শান্তিবাহিনীতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৪ই জুন ১৯৮৩ থেকে শুরু হয়ে গৃহযুদ্ধ ৩০ এপ্রিল ১৯৮৫ তে এস শেষ হয়। যে গৃহযুদ্ধে জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মহান নেতা এমএনলারমা সহ বহু আদর্শিক জুম্ম সৈনিককে জুম্ম সমাজ হারিয়েছে।

গৃহযুদ্ধের পর জনসংহতি সমিতি পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করতে থাকে। জুম্ম নেতৃবৃন্দের দাবী ও জেলবন্দী অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানকল্পে সন্তু লারমার দেয়া ৪৩পৃষ্ঠার সুপারিশনাম অনুযায়ী স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে প্রথম জেএসএস ও বাংলাদেশ সরকারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের সাথে ২৬বারের বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং চুক্তির মাধ্যমেই ১৯৯৮ সালের ২, ১০, ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মোট ৪ দফায় ১৯৪৭ জন শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমাদানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু হায় দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র আন্দোলন, অস্ত্র জমাদান সবকিছুই যেন আজ বৃথা। চুক্তি স্বাক্ষরের আজ ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্খা আজ ভুলন্টিত। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, হাজার হাজার জুম্ম জনগণের প্রাণ উৎসর্গ, ধর্ষিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো, জায়গা-জমি বেদখল, লুটপাত-অগ্নিসংযোগ, নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, শরনার্থী হওয়া সবকিছুই আজ বৃথা।

শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর হবে আগামীকাল। সবকিছুরই বয়স বেড়ে যাচ্ছে, সময় বয়ে চলেছে অবিরত। এরই মাঝে জুম্ম জনগণ আজও হতাশায় নিমজ্জিত, এ ত্যাগ, আন্দোলন-সংগ্রামের বিনিময়ে কি পেয়েছে জুম্ম জনগণ? জুম্ম জনগণের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা হলো শান্তিবাহিনীরা, জুম্ম জনগণের ইতিহাসে আজীবন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে রবে তোমরা। তোমাদের আত্মত্যাগ আমরা ভুলবোনা।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।]

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

পিসিপি মহালছড়ি থানা শাখার ১১তম সম্মেলন ও কাউন্সিল সম্পন্ন
পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার ৫ম সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu