রোহিঙ্গা বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে

আন্তর্জাতিকদেশ

ভেনগার্ড ডেস্ক

যতোই দিন যাচ্ছে ততই পরিষ্কার হয়ে উঠছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে কার্যত কেউ নেই। চীন, ভারত এমনকি মুসলিম দেশগুলোও না। লিপ সার্ভিস ছাড়া তারা বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। বস্তুতই তাদের অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে। মুসলিম দেশগুলো এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আত্তীকরণ করে নেয়ার কথা বলতে শুরু করেছে। এককাঠি এগিয়ে সৌদিআরব, তার দেশের ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো শুধু বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণ করার কথা বলছে না, বরং সাগরে ভেসে থাকা রোহিঙ্গাদেরও গ্রহণ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। বোধকরি, মিয়ানমারে অবশিষ্ট থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ গ্রহণ করলে তারা আরো খুশি। কার্যত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য ছাড়া আর কিছু পায়নি। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের যে রায় নিয়ে বাংলাদেশ অতি আশাবাদী, বেলাশেষে তাও পরিণত হতে পারে হতাশায়। কারণ এই রায় তামিল করতে আইসিজের হাতে কিছু নেই। আইসিজের মুরুব্বি জাতিসংঘও এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না। কারণ সেখানে ভেটো কার্ড খেলার-খেলোয়াড়ের অভাব হবে না। আসলে মিয়ানমার এমন একটি দেশ, যার নিকট অতীতে টানা দুই দশক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে সার্ভাইভ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই আইসিজের এই রায়কে থোড়াই কেয়ার করা তাদের জন্য মামুলি ব্যাপার। মূলত আইসিজের রায় বাংলাদেশের সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না, এটি বরং পাশ্চাত্য ও বেনিয়াদের মিয়ানমারে বাণিজ্য ও সুবিধা আদায়ে কিছু বার্গেইনিং পয়েন্ট ভারি করবে মাত্র। আমেরিকা এখন রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে বাংলাদেশকে চীন বিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগ দেয়াতে চায়। এছাড়া তার পকেটেও রোহিঙ্গা ম্যানেজমেন্টের টেন ইয়ার্স প্ল্যান, অবধারিতভাবে সেটা বাংলাদেশের মধ্যেই। অন্যদিকে ইউরোপ, মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনে ইউরোপ যে অ্যাপটি তৈরি করে দিয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের পরিচিতি মুছে ফেলে বাঙালি মুসলিম বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে।

অনেকে মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের এ অবস্থার জন্য তার নীতিগত দুর্বলতা দায়ী। কারো কারো মতে, সরকারের ভিত্তি দুর্বল। তাই সাহসী ও শক্ত ভূমিকা রাখাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি না থাকাও কম দায়ী নয়।

অন্যদিকে মিয়ানমার বলিষ্ঠ কূটনীতির সাহায্যে ধীরে ধীরে তার অন্যায় অবস্থানের কাছে বিশ্বকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে। অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে মিয়ানমার জিততে চলেছে। সেকারণে বাংলাদেশের ‘স্বামী-স্ত্রী’র মতো সম্পর্কের ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন এবং সাবমেরিন বিধ্বংসী টর্পেডো দিয়ে সাহায্য করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সাবমেরিন, টর্পেডো কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। রাখাইনে শেল্টার হাউজ নির্মাণের গল্প শুনিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বললেও মিয়ানমারে গিয়ে তা ভারতীয় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে পরিবর্তিত হয়ে যায়। সবকিছু দিয়েও তিস্তায় একঘটি পানিও পায়নি বাংলাদেশ। অন্যদিকে চীন মিয়ামারের দুর্দিনের বন্ধু। তার অবস্থান কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

এদিকে যতোই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ ও উপদলীয় কোন্দলে খুনের ঘটনা ঘটছে। এতে যে শুধু রোহিঙ্গারাই খুন হচ্ছে তা নয়, বরং স্থানীয় বাঙালিরাও খুন হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অসামাজিক কার্যক্রম ও অস্থিরতার কারণে স্থানীয় বাঙালিরা জমি-বসতভিটা বিক্রি করে সাধ্যানুয়ায়ী কক্সবাজার, চট্টগ্রাম বা ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। তাদের সে জমি-ভিটা বিভিন্ন কৌশলে কিনে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। উখিয়া-টেকনাফের হাট-বাজার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। স্থানীয় পর্য়ায়ে, কক্সবাজার, এমনকি চট্টগ্রামেও বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কর্মস্থলে মালিকরা সস্তা শ্রমিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছে। এতে করে স্থানীয় পর্যায়ের ডোমোগ্রাফিক সূচকগুলো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ফলে তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা বিদ্বেষ বাড়ছে দিনকে দিন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতার জন্য চাঁদাবাজি, বাজার দখল ও মাদক ব্যবসাকে দায়ী করা হলেও বিষয়টা এতোটা সরলীকরণ নাও হতে পারে। কেননা, যেভাবে ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামী দিনে হয়তো আওয়াজ উঠতে পারে বাংলাদেশ এককভাবে রোহিঙ্গা ম্যানেজমেন্ট ও নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। তাই বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বা সহায়তা প্রয়োজন। হয়তো এ উদ্দেশ্য সাধনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যেও ক্যাম্পে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কেননা, ক্যাম্পে সহিংসতার জন্য দায়ী আরসার যে দুই গ্রুপ, সেই আরসার নাটাই কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে। এর জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে এবং নিয়ন্ত্রিত হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকেই। আর মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটিশ-আমেরিকা-ইসরাইল। আরসা বা রোহিঙ্গা ক্যাম্পেকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বকোণে জঙ্গিবাদের উত্থানের ষড়যন্ত্রের কথা অনেক আলোচিত হয়েছে। এই অঞ্চলকে আরেকটি রাকা, আরেকটি মসুলে পরিণত করার কথাও আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়টিও বাংলাদেশের মাথায় রাখতে হবে।

মাঝে মধ্যে আরসা মিয়ানমার আর্মির উপর টুকটাক হামলা চালালেও সেটা মিয়ানমারের স্বার্থ উদ্ধার করে। রোহিঙ্গাদের তাড়াতে যেমন মিয়ানমার আরসার ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে’ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছিল, এখনো তাই করছে। মিয়ানমারের বার্তা সংস্থা ইরাবতীতে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, সর্বশেষ জাতিসংঘের অধিবেশনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলে বলেন, Both the terrorist group ARSA [the Arakan Rohingya Salvation Army] and the terrorist insurgent group AA [the Arakan Army] have used Bangladeshi territory as a sanctuary.

অবশ্য মিয়ানমার এখন শুধু অভিযোগই তুলছে না, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও আরসার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে সর্বাত্মক লড়াই শুরু করেছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি স্বাধীনতা বা স্বায়ত্ত¡শাসনের দাবি তুলে আরাকানে বসবাসকারী জাতিগত বুড্ডিস্ট রাখাইনদের একটি গোষ্ঠী মিয়ানমার আর্মির উপর ব্যাপকভাবে হামলা শুরু করে। মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত তারা বেশ কিছু সাফল্যও লাভ করেছে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে মিয়ানমার আর্মিও পাল্টা আঘাত হানা শুরু করে। বিশেষ করে মিয়ানমার আর্মির দুই সদস্য আরাকান আর্মির হাতে আটক হওয়ার পর আইসিজেতে যাওয়া ও স্বীকারোক্তি দেয়ার ঘটনার পর তারা অত্যন্ত সিরিয়াস হয়। প্রথমে তারা বাংলাদেশ সীমান্তে সেনা সমাবেশ করে বেষ্টনি তৈরি করে যাতে রোহিঙ্গা বা আরসা কেউ তাদের হামলার মুখে পালিয়ে দুর্গম সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে। এরপর তারা আরাকান আর্মির বিভিন্ন অবস্থানে সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী সহযোগে একত্রে যৌথ হামলা শুরু করে। বিশেষ করে ভারতীয় সেনা প্রধানের মিয়ানমার সফরের পর থেকে এই হামলা অত্যন্ত জোরদার করা হয়। বলা হয়ে তাকে, চীনের সহায়তা পাওয়ার জন্য আরাকান আর্মি সিটুয়েতে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের বিরোধিতা করে তার কাজ আটকে দিয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর সকাল থেকে মিয়ানমার আর্মি বিমান ও নৌ বাহিনীর সহায়তায় রুথিডংয়ে অবস্থিত আরাকান আর্মির শক্ত ঘাঁটিতে হামলা করে। এ লেখার সময় পাওয়া খবরে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর হামলার মুখে টিকতে না পেরে আরাকান আর্মি বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে পালিয়ে গেছে। তাদের অনেক সদস্য হতাহত হয়েছে। অনেকে মিয়ানমার আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মিয়ানমার সরকার তার দেশের বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে শান্তিচুক্তি করে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও রাখাইনে বা আরাকান আর্মির সাথে এমন কিছু করতে আগ্রহী নয় মোটেও। ফলে মিয়ানমার আর্মি হয়তো এবারে আরাকান আর্মির ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত অবস্থানে যেতে চাইছে। অবশ্য সেটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা, পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে মনে হয়, মিয়ানমার এক সময় বাংলাদেশ সীমান্তে দেয়াল তুলে দেবে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়।

সূত্রঃ The Daily Inqilab

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

বান্দরবানে যুবতীকে গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার ২
সাউপ্রু মারমা হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেঃ জেএসএস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu