সিএইচটি ভ্যানগার্ড
জুপিটার চাকমা
আজ ১০ই নভেম্বর। শোকাবহ একটি দিন। জুম্ম জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। ১৯৮৩ সালের এই দিনে ভোর রাতে পার্টির ভিন্নমতাবলম্বী, সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, বিভেদপন্থী ভবতোষ দেওয়ান (গিরি), প্রীতি কুমার চাকমা (প্রকাশ), দেবজ্যোতি চাকমা (দেবেন) ও ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান (পলাশ) চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে মহান নেতা আটজন সহযোদ্ধাসহ শাহাদাৎ বরণ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতি এবং সর্বোপরি দেশের সকল নিপীড়িত জাতি ও মানুষের জন্য এ এক গভীর শোকাবহ ও তাৎপর্যময় দিন। আজকের এই জুম্ম জাতীয় শোক দিবসে মহান নেতা এমএন লারমাসহ মহান বীর শহীদদের অমূল্য আত্মবলিদান গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাদের আত্মার মহান স্মৃতির প্রতি সুউচ্চ সম্মান প্রদর্শন করছি।
মহান নেতা আমদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী চেতনা ও চিন্তাধারা এবং তাঁর অনুস্মরণীয় কাজের দৃষ্টান্ত আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ এবং জুম্ম জনগণসহ বিশ্বের মুক্তিপাগল নিপীড়িত মানুষের বিপ্লবী সংগ্রামের পাথেয় হয়ে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব যখন চরম অবলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছিল, ঠিক তখনি মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মুক্তির অগ্নিমন্ত্র নিয়ে জুম্ম জাতিকে প্রগতিশীল জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগরিত করে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁরই নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের প্রথম ও একমাত্র লড়াকু রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি জুম্ম জনগণের পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মাঝি-মাল্লা তথা সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষের স্বার্থে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ভিতরে ও বাইরে আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি সত্যিকার অর্থে মানবতাবাদী এক বিশ্ব নেতা বলা যায়।
আজকের কাপ্তাই হৃদে বিলীন হয়ে যাওয়া রাঙামাটি শহর থেকে অনতিদূরে মহাপুরম গ্রামে ১৯৩৯ সালে ১৫ই সেপ্টেম্বর একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয় ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র জুম্ম জাতির পিতা মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি মহাপুরম জুনিয়র হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে আই এ, ১৯৬৫ সালে একই কলেজ থেকে বিএ, ১৯৬৮ সালে বিএড আর ১৯৬৯ সালে এল.এল.বি পাশ করেন। তাঁর কর্মময় জীবনে দিঘীনালা হাই স্কুলের শিক্ষক, চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনের আইনজীবি হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। তিনি পাহাড়ী ছাত্র সমিতি গঠনে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নেও কাজ করেছেন। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত চার দফা দাবীনামা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পেশ করেন। বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সর্বশেষ আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যৌবনকালে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। বিপ্লবী জীবনে যদিও স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুব সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। অত্যন্ত মৃদুভাষী, নম্র, ভাব গম্ভীর ও অমায়িক ছিলেন। তিনি নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল ছিল। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল তীক্ষè ও অসম্ভব সৃজনশীল মেধার অধিকারী ছিলেন। অপরিসীম ধৈর্য্য, সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বিদ্যালয়ে পাঠ দানের সময় তাঁর যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি ছিল। তাঁর পাঠ দানের পদ্ধতি এত আকর্ষণীয় ও প্রাঞ্জল ছিল যে শিক্ষার্থীরা খুব সহজে আয়ত্ব করতে পারত। তিনি আইনজীবি হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদানের জন্য লন্ডন গমন করেছেন। এ নেতার জীবনটাই আগাগোড়া রাজনৈতিক মহান কর্মকান্ডে বিজরিত ছিল। তিনি বাল্যকাল থেকেই অধিকার হারা জুম্ম জনগণের মর্মবেদনা ও অভিশপ্ত জীবনধারা বুঝতে পারতেন। নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। ১৯৭১ সালে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। পৃথিবীতে যুগে যুগে দেশে দেশে যেমনি প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাধী, আপোষকামী ও লেজুড় শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব দেখা যায়, একমাত্র মহান নেতা এম এন লারমা তাঁর দূরদর্শী প্রগতিশীল চিন্তাধারার আলোকে অতি দক্ষতা, বিচক্ষণতা, রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করে অত্যন্ত সুকৌশলে এসব সমস্যা মোকাবেলা করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মহান এ নেতাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হীন ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্ররা নির্মমভাবে হত্যা করে ৪১ বছর আগে। চার এ প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রীরা আপোষহীন ও মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু এম এন লারমাকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন, দর্শন ও বিপ্লবী চেতনাকে নিঃশেষ করে দিতে পারেনি। জুম্ম জাতির মহান এ নেতার প্রদর্শিত আদর্শের চেতনাকে ধারণ করে বিপ্লবী মশাল জে¦লে জীবন বাজি রেখে আজও সংগ্রাম করে চলেছে শত শত অকুতোভয় সাহসীযোদ্ধা। কাজেই ইতিহাস প্রমাণ করেছে শহীদ এমএন লারমা জীবন্ত এম এন লারমার চেয়ে আরো অনেক শক্তিশালী ও মহান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর হতে চলেছে। দেশের সাধারণ মানুষ তথা জুম্মদের এখনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আসেনি। দেশের গণপরিষদ তথা জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জুম্মদের প্রতিনিধি হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার ঐতিহাসিক ভাষণে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত বঞ্চিত জুম্ম জনগণের বাঁচার দাবী উত্থাপন করেছিলেন। তিনি দাবী করেছেন, জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্কীকৃতিও দাবী করেছিলেন।
এমএন লারমা স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজজীবন, যে সমাজজীবনে জাতিভেদ থাকবেনা, লিঙ্গভেদ থাকবেনা, থাকবেনা কোন প্রকার ভেদাভেদ। সে ধরণের ভেদাভেদমুক্ত একটা সমাজজীবন শুধু পাহাড়ে নয়, পার্বত্য অঞ্চলে নয়, সমগ্র বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে। তিনি আরো স্বপ্ন দেখেছেন, আদিবাসী মানুষরা নিজেদের মৌলিক অধিকার ও পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকবেন এবং বেঁচে থাকার জন্য একটা সামাজিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করবেন। আমরা যদি বর্তমান বাস্তবতার দিকে তাকাই, তাহলে কি সেই মহান নেতার স্বপ্ন বাস্তবিক রুপ দেখতে পাই? পাইনা। সত্তর দশকে মহান নেতা এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, “স্বপ্ন দেখা সহজ কিন্তু সেই স্বপ্ন সহজতরভাবে বাস্তবায়ন নাও হতে পারে”।
কাজেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যারা এম এন লারমার জীবন দর্শনের সাথে যুক্ত তাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে হবে। অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত খালি হাতে ফিরে আসা যাবেনা। নাহলে, এম এন লারমার সেই লালিত স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। কাজেই মহান নেতার স্বপ্নকে কোন মতেই বৃথা যেতে দিতে পারিনা।
বলাবাহুল্য, জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত এমএন লারমা বেঁচে থাকলে তাঁর স্বপ্নগুলো যেমনি এতদিনে বাস্তবে রুপ পেতো, তেমনি পার্টিও দ্বিধা-বিভক্ত হতো না। এমনকি গৃহযুদ্ধের সময়ে বিবাদমান দুই দলের ঐক্য প্রচেষ্টায় “ক্ষমা করা ভূলে যাওয়ার” নীতিতে অবিচল থাকতে গিয়েই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি জুম্ম জাতির ঐক্য সাধনে অটল ছিলেন। তাঁর এই মহান প্রয়াসকে জুম্ম জাতি আজও স্মরণ করে এবং সুদৃঢ় ঐক্য কামনা করে।
মহান নেতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি, মানুষ ও ভূ-প্রকৃতিকে নিয়ে একাকী মনে গভীর হৃদয়ে অবগাহন করতেন। তিনি নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতি তাঁর সজাক দৃষ্টি ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতিও আগের মত নেই। আগে ছিল প্রকৃতির অঢেল সম্পদ। সেই সম্পদ ভোগ করতে না ছিল প্রতিবন্ধকতা, না ছিল প্রতিদ্বন্ধিতা। কিন্তু ইদানিং আর সেই অবাধ বিচরণের পদচারণা আর নেই। প্রকৃতির অপার উদারতা আর নেই। সেই প্রকৃতি আজ ক্ষত-বিক্ষত। তাই এখন গাছ বাঁশ কাট্টনের কথা বাদ দিয়ে খেটে খাওয়া জুম্ম জনগণকে ছুটতে হচ্ছে শহরের দিকে। এইভাবে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন সংগ্রামের ধরণ। প্রকৃতির পাহাড়ী গিরি-ঝর্ণা ও নদীর দুর্বার গতি এখন আর নেই। কারণ সেই স্রোতধারা ধারা এখন বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার যারা চাই তাদের অবশ্যই বহুধাবিভক্তি কাটিয়ে একই স্রোত মোহনা সৃষ্টি করতে হবে। নইলে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কখনই আগের মত দুর্বার, দুর্জয় ও শাণীত হতে পারবেনা।
বিশ্বাসঘাতক ও জাতীয় শত্রুরা মহান নেতা এমএন লারমাকে হত্যা করেনি একই সাথে গোটা জুম্ম জাতিকেও গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। যে ব্যক্তি একটি জাতিকে ঘোর অন্ধকার থেকে তুলে এনে পৃথিবীর বুকে ঠিকে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন, যাঁর বলিষ্ট নেতৃত্বের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অধিকার থাকবেনা, লিঙ্গভেদ থাকবেনা, থাকবেনা কোন প্রকার ভেদাভেদ। সে ধরণের ভেদাভেদমুক্ত একটা সমাজজীবন শুধু পাহাড়ে নয়, পার্বত্য অঞ্চলে নয়, সমগ্র বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বাস। তিনি আরো স্বপ্ন দেখেছেন, আদিবাসী মানুষরা নিজেদের মৌলিক অধিকার ও পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকবেন এবং বেঁচে থাকার জন্য একটা সামাজিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করবেন। আমরা যদি বর্তমান বাস্তবতার দিকে তাকাই, তাহলে কি সেই মহান নেতার স্বপ্ন বাস্তবিক রুপ দেখতে পাই? পাইনা। সত্তর দশকে মহান নেতা এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, “স্বপ্ন দেখা সহজ কিন্তু সেই স্বপ্ন সহজতরভাবে বাস্তবায়ন নাও হতে পারে”।
কাজেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যারা এম এন লারমার জীবন দর্শনের সাথে যুক্ত তাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে হবে। অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত খালি হাতে ফিরে আসা যাবেনা। নাহলে, এম এন লারমার সেই লালিত স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। কাজেই মহান নেতার স্বপ্নকে কোন মতেই বৃথা যেতে দিতে পারিনা।
বলাবাহুল্য, জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত এমএন লারমা বেঁচে থাকলে তাঁর স্বপ্নগুলো যেমনি এতদিনে বাস্তবে রুপ পেতো, তেমনি পার্টিও দ্বিধা-বিভক্ত হতো না। এমনকি গৃহযুদ্ধের সময়ে বিবাদমান দুই দলের ঐক্য প্রচেষ্টায় “ক্ষমা করা ভূলে যাওয়ার” নীতিতে অবিচল থাকতে গিয়েই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি জুম্ম জাতির ঐক্য সাধনে অটল ছিলেন। তাঁর এই মহান প্রয়াসকে জুম্ম জাতি আজও স্মরণ করে এবং সুদৃঢ় ঐক্য কামনা করে।
মহান নেতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি, মানুষ ও ভূ-প্রকৃতিকে নিয়ে একাকী মনে গভীর হৃদয়ে অবগাহন করতেন। তিনি নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতি তাঁর সজাক দৃষ্টি ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতিও আগের মত নেই। আগে ছিল প্রকৃতির অঢেল সম্পদ। সেই সম্পদ ভোগ করতে না ছিল প্রতিবন্ধকতা, না ছিল প্রতিদ্বন্ধিতা। কিন্তু ইদানিং আর সেই অবাধ বিচরণের পদচারণা আর নেই। প্রকৃতির অপার উদারতা আর নেই। সেই প্রকৃতি আজ ক্ষত-বিক্ষত। তাই এখন গাছ বাঁশ কাট্টনের কথা বাদ দিয়ে খেটে খাওয়া জুম্ম জনগণকে ছুটতে হচ্ছে শহরের দিকে। এইভাবে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন সংগ্রামের ধরণ। প্রকৃতির পাহাড়ী গিরি-ঝর্ণা ও নদীর দুর্বার গতি এখন আর নেই। কারণ সেই ¯স্রোতধারা এখন বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার যারা চাই তাদের অবশ্যই বহুধাবিভক্তি কাটিয়ে একই স্রোতের মোহনা সৃষ্টি করতে হবে। নইলে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কখনই আগের মত দুর্বার, দুর্জয় ও শাণীত হতে পারবেনা।
বিশ্বাসঘাতক ও জাতীয় শত্রæরা মহান নেতা এমএন লারমাকে হত্যা করেনি একই সাথে গোটা জুম্ম জাতিকেও গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। যে ব্যক্তি একটি জাতিকে ঘোর অন্ধকার থেকে তুলে এনে পৃথিবীর বুকে ঠিকে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন, যাঁর বলিষ্ট নেতৃত্বের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে যে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে, সে জাতি আজ তাকে কখনও ভূলবে না, ভূলতে পারবেনা। মহান নেতা আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর প্রগতিশীল আদর্শ আজও প্রতিটি মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের হৃদয়ে জীবন্ত হয়ে রয়েছে এবং আগামীতেও থাকবে। তাঁর দেখা স্বপ্ন আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। এম এন লারমা শুধু পাহাড়ী জনগণের বন্ধু নয়। বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশে^র মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু।
১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর। খসড়া সংবিধানের উপর কথা বলতে গিয়ে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একাই লড়ে গেছেন। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াননি। তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কেউ কেউ উপহাস করেছেন। তাঁর জন্য ছিল এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। মহান নেতা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসী। আমি সেখানকার উপজাতীয় এলাকার লোক। সেখানকার কোন কথাই এই সংবিধানে নেই। যুগে যুগে ব্রিটিশ শাসন থেকে আরম্ভ করে সব সময় এই এলাকা স্বীকৃত হয়েছিল। অথচ আজকে এই সংবিধানে সেই কথা নাই। আমাদের এলাকা একটি উপজাতীয় এলাকা। এখানে বিভিন্ন জাতি বাস করে। এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই,বম, পাংখোয়া, খুমী, খিয়াং, মুরং, এবং চাক এইরুপ ছোট ছোট ১০টি উপজাতি বাস করে। এই উপজাতির কথা ব্রিটিশ সরকার পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিল। পৃথিবীর অন্যতম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নেও উপজাতিদের অধিকার আছে। পৃথিবীর আরেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র- আমরা সেখানে দেখি তাদের সংবিধানে বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। জানিনা আমরা কি অপরাধ করেছি। আমরা করুণার পাত্র হিসাবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসাবে। তাই মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার আমাদের আছে। কেন আমরা অভিশপ্ত জীবনযাপন করব। পাকিস্তানের সময় আমাদের ছিল অভিশপ্ত জীবন। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র হতে চলেছে। এই সংবিধানে আমাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে হবে। কিন্তু তুলে ধরা হয়নি। যদি আমাদের কথা ভুলে যেতে চান, যদি ইতিহাসের কথা ভুলে যেতে চান, তাহলে তা আপনারা পারেন। কিন্তু আমি তা পারিনা। উপজাতিরা কি চাই ? স্বাধীন গণপরিষদে তারা চায় তাদের সত্যিকারের অধিকারের নিশ্চয়তা। আমাদের নাগরিকত্বের যে সংজ্ঞা তা ভালোভাবে বিবেচনা করে যথোপযুক্তভাবে গ্রহণ করা উচিত। আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙ্গালিদের সঙ্গে লেখাপড়া শিখে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ কেউ বলে নাই- আমি বাঙালি। আমার সদস্য-সদস্যা ভাইবোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানিনা আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চাই। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে কোন দিনই বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আজ আমাদের চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশী বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
এমএন লারমা রাষ্ট্রসভায় দেশের নিপীড়িত জনগণের হয়ে প্রশ্ন করেছেন, রাষ্ট্রের সংবিধানকে নানান জায়গা থেকে প্রশ্ন করেছেন এবং বারেবারে অধিপতি রাষ্টের কাছে তুলে ধরেছেন নিম্নবর্গের কথা। বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্কে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলোচনায় এমএন লারমা বলেছিলেন, … মাননীয় স্পিকার, এই পরিষদের সামনে আমার বক্তব্য হলো আজকের খসড়া সংবিধান যদি এই গণপরিষদে গৃহীত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমার যে আপত্তি আছে, সে আপত্তি হলো- আমার বিবেক, আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা পুরোপুরি এ সংবিধানে নেই। যদি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা এই সংবিধানে থাকত, তাহলে আমার আপত্তির কোন কারণ থাকত না। কিন্তু আজ আমি দেখতে পাচ্ছি পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ^রী, বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়েছে তাদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি। আজকে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আপনারা বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের কথা সমাজতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের নামে বলে চলেছেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবু আমার বিবেক বলছে, এই সংবিধানের কোথায় যেন গলদ রয়েছে। মাননীয় স্পিকার সাহেব, আজকে যারা কল-কারখানার চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, প্রতিটি জিনিষ তৈরী হচ্ছে, সেই লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের মনের কথা এখানে নেই।
গণপরিষদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আরো বলেন, আজ বঞ্চিত মানুষের মনের কথা তুলে ধরতে চাই। সেই বঞ্চিত মানুষদের একজন হয়ে আমি বলতে চাই, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা যারা নির্যাতিত, সেই পাকিস্তান আমলে যে নির্যাতন ভোগ করেছি সেই নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে চাই। আমরা মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাই। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছে। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই। তাই আজ আমি বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে কী অপরাধ করেছে, তা আমি জানি না। পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো বিভিন্ন জাতিসত্তার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেলনা, তা আমি ভাবতে পারিনা। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে পেশকৃত এই সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছিনা।
২০২৪ ইং ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই চিন্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজকের প্রজন্ম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের দাবী তুলেছে- যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশী- এই চেতনা লারমার দার্শনিকতা ও সাম্যবাদের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। নতুন প্রজন্মের গ্রাফিতি ও রাজনৈতিক চেতনায় মহান নেতার চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। যেখানে পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব এবং উন্নয়নের নামে নিপীড়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এমএন লারমার চিন্তার কেন্দ্র ছিল রাষ্ট্রের এমন এক রুপান্তর, যেখানে কৃষি, শ্রমজীবী মানুষ এবং প্রান্তিক সম্প্রদায় সবাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মর্যাদার সাথে বসবাস করবে। মহান নেতার সংবিধান দর্শন বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল। যেখানে সমাজের সকল শ্রেণী, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের আকাঙ্খার প্রতিফলন থাকবে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা শ্রেণী এবং জাতিগত বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে সবার স্বার্থকে সুরক্ষা দেবে।
১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় মহান নেতা এমএন লারমা রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণে বাঙালি পরিচয়ের ওপর এক তরফা জোর দেওয়ার বিরোধিতা করেন। কারণ এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে। মহান নেতা বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয় অবশ্যই সকল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দেওয়া হবে। তিনি উন্নয়ন ও ভূমি অধিকার নিয়ে বিনাশী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন যা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জুমচাষ ও কৃষি ঠিকে থাকার ওপর হুমকি তৈরী করেছিল।
নারীর অধিকার নিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অবস্থান ছিল খুবই স্পষ্ট। সংবিধানে নারীর অধিকার নিয়ে কোন স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় তিনি এটিকে সমালোচনা করেন এবং বলেন, সমাজের অর্ধেক অংশ হিসেবে নারীর অধিকারকে উপেক্ষা করা চলবেনা। তিনি নারীকে পুরুষের সাথে সমান অধিকারের দাবীদার হিসেবে দেখতেন, যা তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। মহান নেতা উন্নয়ন, ভূমি, অধিকার এবং নিম্নবর্গের প্রান্তিকতা নিয়ে যে চিন্তা করেছিলেন, তা মূলত পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি দেখেছিলেন পুঁজিবাদী শোষণমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ও তাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছে। মহান এ নেতার রাজনৈতিক দর্শন কৃষি, ভূমি এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছিল। তিনি বিনাশী উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সামগ্রিক উন্নয়নকে মানবিক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে পরিচালিত করার আহব্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, তর্কহীন সমাজ মৃত সমাজ। আমরা এমন এক সময়ে এমএন লারমাকে নিয়ে বলছি, যখন ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থান পরবর্তী সময়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের সংস্কারের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ পর্যায়ে এসে মানবেন্দ্র লারমার দর্শন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু আমরা এখন কি দেখছি। আমরা দেখছি রাষ্ট্র সংস্কারে নারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে আদিবাসীদের। আমরা বরং দেখতে পাই মৌলবাদীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ধণাঢ্য শ্রেণীদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। আন্দোলনের সময় আমরা যে কল্পনা চাকমাকে উদ্ধৃত করেছিলাম আন্দোলনের পরে তাকে কি কেউ খোঁজার চেষ্টা করেছি ? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, সিস্টেম বদলায়নি।বর্তমান এই সংবিধান একটি সামন্তবাদী সংবিধান। এ সংবিধান কেবল মুসলমানের, এ সংবিধানে অন্য ধর্মের স্বীকৃতি নেই। এই সংবিধান কেবল বাঙালির, এখানে অন্য কোন জাতির স্থান দেওয়া হয়নি। এদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র সিস্টেমে বহুত্ববাদের স্থান দেওয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশ একটি বহুভাষা, বহুজাতির, বহু সংস্কৃতির দেশ। আমরা এখন যে অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি সে অন্তর্ভুক্তিতে সকল শ্রেণীর মানুষের কথা বলতে হবে। বহুত্ববাদী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে সংবিধান সংস্কার করা হচ্ছে সেখানে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সমাজ দর্শনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জাহাঙ্গীনগর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুল সুমন মনে করেন, এমএন লারমাই প্রথম, যিনি জাতি এবং জাতীয়তার ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত আদিবাসীদেরকে আমরা সব সময় উপনিবেশিক চশমা দিয়ে দেখি। তা ঠিক নয়। আজকের নতুন বাংলাদেশে আমরা এথনিসিটি নির্ধারণ করার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের সমতল অঞ্চলেও যে সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমরা মনে করি, ১৯৭২ সালের সংবিধান বির্তকে এমএন লারমা শুধুমাত্র আদিবাসীদের কথা বলেননি বরং দেশের সকল মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন। তিনি শোষণহীন, বঞ্চণাহীন সমাজের কথা বলেছেন। তিনি কোন নির্দিষ্ট জাতির নেতা নন, তিনি একজন জাতীয় নেতা। আমরা একটি ইতিহাসের সন্ধিঃক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। একটি বড় রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে পরাভূত করে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে সে সংস্কারে আদিবাসীদের ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্ম প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনে হাত দিয়েছে সেখানে মহান নেতার উত্থাপিত দাবী অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না করলে সেই বৈষম্যহীন আকাঙ্খার প্রতিফলন হবেনা।
তাই, দেশের নিপীড়িত জনগণের হয়ে যিনি রাষ্ট্রসভায় নিজের মতো লড়ে গেছেন আজ সেই অবিস্মরণীয় মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৭২’র খসড়া সংবিধানে উত্থাপিত দাবী নতুন বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারে তুলে ধরতে হবে। আমরা আশা করি, রাষ্ট্রের চলমান ইতিহাসে মহান নেতার চিন্তা ও চেতনাকে আড়াল করা হবেনা। জনগণের নেতা এমএন লারমা আমাদের সকল নথি ও পাঠ্যে সশ্রদ্ধ ও মর্যাদায় জায়গা পাবেন অচিরেই। প্রচলিত অধিপতি ইতিহাস ভেঙ্গে আবার শুরু হবে এমএন লারমার মতো সত্যিকারের সাহসী মানুষের ইতিহাস, দেশের গণমানুষের জীবনের পাতায় পাতায়। তাঁর প্রদর্শিত পথ ও নির্দেশিত নীতিকৌশল আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায়ের সংগ্রামে একমাত্র দিশারী হয়ে উঠুক। মহান নেতার আত্মত্যাগ তিতিক্ষা যুগে যুগে দেশের প্রতিটি মুক্তিকামীর এক জলন্ত অনুপ্রেরণার উৎসস্থল।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি।
[প্রবাহণ, ১০ নভেম্বর ১৯৮৯ স্মরণে ২০২৪, ১৩তম সংখ্যায় প্রকাশিত প্রকাশনা থেকে নেয়া]