বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৮৫তম জন্মবার্ষিকী আজ

Opinion

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, সাবেক সাংসদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী আজ।

১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের মাওরুম (মহাপ্রুম) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ও মাতা সুভাষিণী দেওয়ান। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য় । বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাষ লারমা(বুলু),বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা এবং ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু)। তার সহধর্মিনীর নাম পঙ্কজিনী চাকমা এবং ছেলে জয়েস লারমা, মেয়ে পারমিতা লারমা । মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় মহাপ্রুম জুনিয়র হাইস্কুলে । ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন । চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ ও ১৯৬৮ সালে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন । ১৯৬৯ সালে এলএলবি ডিগ্রীও অর্জন করেন ।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । ১৯৫৬ সালে পাহাড়ী ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন, এরপর পাহাড়ী ছাত্র সমাজকে আন্দোলনে সংগঠিত করতে শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে যোগ দেন পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়নে । ১৯৬০ সালের দিকে পাহাড়ী মানুষের মরন ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে সাথে নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তুলেন । কাপ্তাই বাঁধের ভয়াবহতার কথা লিফলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে সচেতন ও প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন । কাপ্তাই বাধেঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের নিকট আটক হন । ১৯৬৫ সালের ৮ই মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান । ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন । ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জাতিগোষ্ঠীগুলোকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪দফা দাবীনামা পেশ করেন । মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানে এদেশের মূল জাতিগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। লারমা’র দাবী তখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়: ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’

এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন জুম্ম জনগণের প্রতিনিধি এম এন লারমা । এর আগে খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়, তাতে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে । কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।”

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন করার প্রাক্কালে লারমা উগ্র আধিপত্যবাদী বাঙালী জাতীয়তবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন । তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শাসন ব্যবস্থাসহ জুম্ম জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী করেন । সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রীয় শক্তি লারমার ন্যায্য দাবিকে প্রত্যাখান করে । জুম্ম জনগণের পাশাপাশি দেশের কৃষক, তাঁতি, জেলে, মাঝি-মাল্লা, কলকারখানার শ্রমিক-সহ সকল মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লারমা গণপরিষদে সোচ্চার দাবি রেখেছিলেন। সংবিধানে সকল ধর্ম ও নারীর সমমর্যাদা রক্ষার জন্য লারমা বারংবার আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়নের সময় লারমা ছিলেন নিসঙ্গ অভিযাত্রী। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিলো অমিত তেজ । গণপরিষদে বার-বার তাঁর মাইক বন্ধ করা হলেও ফ্লোর পেলেই তিনি জুম্ম জনগণের কথা, নারী অধিকার এবং মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলতেন। লারমা সাম্যবাদী দর্শনের সৈনিক ছিলেন ছাত্র জীবন থেকেই। মার্কসীয় সমাজ বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করে শ্রমজীবি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা থেকে তিনি সংবিধান প্রণয়নের সময় শ্রমিক, মেহনতি জনতা ও নিপীড়িত জাতিসমূহের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন ইংল্যান্ডে । তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগদান করেছিলেন।

১৯৭৩ সালের ০৭ জানুয়ারি গড়ে তুলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হলে তিনি পরের দিনই আত্মগোপনে চলে যান । একই সাথে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মহিলা সমিতি, জুমিয়া সমিতি, যুব সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী । মার্ক্সীয় আদর্শ তিনি ধারণ করেছিলেন তার আন্দোলনের জন্য। পরে জিয়াউর রহমান সমতল থেকে নদী ভাঙা অঞ্চলের বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিবাসিত করলে তাদের সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে।

একসময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম শিক্ষিত সমাজকে গ্রামে চলো স্লোগানে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং জুম্ম শিক্ষিত সমাজ পাহাড়ে ফিরে এসে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতার পেশায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জুম্ম সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছুটে বেরিয়েছেন। জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় অধিকাংশ কর্মীই ছিলেন শিক্ষক,যার কারণে এই আন্দোলনের নাম টিসার্চ রিভ্যুলেশন নামেও সমধিক পরিচিত । এদেশের সেনাবাহিনীরাও নাম দিয়েছিলেন টিসার্চ রিভ্যুলেশন।মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজেও ১৯৬৬ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি, যে সংগঠন এমএন লারমার নিজ হাতে গড়া । ঘুমন্ত জুম্মসমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন অধিকার আদায়ের জন্যে।আন্দোলন-সংগ্রাম শিখিয়েছেন জুম্ম সমাজে । মেহনতী মানুষের কথা বলেছেন সবসময়। তাইতো আজো পাহাড়ে পাহাড়ে এমএন লারমার জয়গাথা উচ্চারিত হয়। কাপ্তাই বাধেঁর কারণে যেদিন উদ্ভাস্ত হয়ে চলে যাচ্ছিলেন নিয়েছিলেন এক মুঠো মাটি, কি প্রতিজ্ঞা ছিলো আমরা জানিনা, তবে এটুকু আমরা বলতে পারি যে জন্মভূমিকে মুক্তিই ছিল তার লক্ষ্য ।

১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮২ সালেও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন । মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দলেও সৃষ্টি হয় অন্তর্দন্ধ এবং দলটি ২টি ধারা এমএন লারমার নেতৃত্বে লাম্বা গ্রুপ ও প্রীতি কুমার চাকমার নেতৃত্বে বাদি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। দলীয় ঐক্যকে সংহত করার লক্ষ্যে লারমা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সে-দিকে পথ বাড়াননি । ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ গভীর রাতে তারা লারমার গোপন ঘাঁটিতে হামলা চালায় । লারমাকে রক্ষার জন্য লারমার সহযোদ্ধারা আমরণ লড়াই চালিয়ে যান। জুম্ম জনগণের মহান নেতাকে রক্ষার সকল প্রতিরোধ অতিক্রম করে ঘাতকরা লারমার কাছে পৌঁছে যায়। ঘাতকের নির্মম বুলেট নিপীড়িত জনতার মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনানী লারমার বুক ঝাঁঝরা করে দেয় । ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ চক্রদের বুলেটে নিভে যায় লারমার জীবন প্রদীপ। সাথে শহীদ হন লারমার ৮ সহযোদ্ধা। ঘাতকের বুলেট লারমার জীবন কেড়ে নিয়েছে সত্য। তবে লারমার আত্মত্যাগ, তাঁর জীবন দর্শন প্রতিনিয়ত নিপীড়িত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে । নির্লোভ ও নির্মোহ জীবন যাপনে লারমা চিরকাল অনুকরণীয়। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রকার ভোগবাদ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি । আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সব সময় আপোষহীন। সাচ্চা, ত্যাগী বিপ্লবী এ-নেতার জীবন তাই মরণেই থেমে থাকে না। ঘাতকেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হয়েছে অনেক আগে । কিন্তু লারমা চির দীপ্যমান।

প্রতিবছর তাঁর আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ অনারম্ভরভাবে তাঁর জন্মদিবস উদযাপন করে থাকেন। এ বছরও মহান নেতার জন্মদিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গিয়েছে।

Tags: , , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

ইউপিডিএফের সচিব চাকমা, রঞ্জন মনি চাকমা ও অক্ষয় চাকমার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ!
লংগদুতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu