সিএইচটি ভ্যানগার্ড, বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি
মহান নেতা এমএন লারমা’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস গতকাল (১০ নভেম্বর ২০২৪) জনসংহতি সমিতি বাঘাইছড়ি থানা কমিটির উদ্যোগে সদরের জীবঙ্গাছড়া(বাবু পাড়া) এবং রুপালী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রুপকারী ও বঙ্গলতুলী ইউনিয়নের এলাকাবাসীর উদ্যোগে নানা আয়োজনে পালিত হয়।
জীবঙ্গাছড়া (বাবু পাড়া)
সকাল ৮ ঘটিকায় মহান নেতা এমএন লারমা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে আত্মবলিদানকারী সকল বীর শহীদদের স্মরণে অস্থায়ী শহীদ ভেদীতে জীবঙ্গাছড়ার(বাবু পাড়া) সর্বস্তরের জনগণসহ জনসংহতি সমিতি এবং বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
সকাল ৯ ঘটিকার সময় মহান নেতা এমএন লারমাসহ সকল বীর শহীদদের স্মরণে শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত শোক সভায় জনসংহতি সমিতি বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক শ্রী রুবেল চাকমা চাকমার সঞ্চলনায় – শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী জ্ঞানসিন্দু চাকমা। শোক প্রস্তাব পাঠ শেষে সকল বীর শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট মৌনব্রত পালন করা হয়। শোক সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র বাঘাইছড়ি থানা কমিটির নেত্রী শেফালী চাকমা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী নেতা প্রফুল্ল কুমার চাকমা স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জ্যোসি চাকমা। শোক সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, শিজক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জ্ঞান চাকমা; করেঙ্গাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত মনি চাকমা; কাচালং বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভদ্রসেন সেন চাকমা প্রমূখ।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এমএন লারমা’র পশ্চাৎপদ জুম্ম সমাজে শিক্ষার বিস্তার, অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, বন্য প্রাণী সংরক্ষণসহ অধিকারের প্রশ্নে আন্দোলনের যে পথের সন্ধান দিয়েছেন তাঁর বিস্তারিত আলোচনা করেন। সামন্তীয় চিন্তাধারা, অশিক্ষা-কুশিক্ষায় জর্জরিত দশ ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের অধিকারের জন্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদের ভিতরে ও বাইরে লড়াই সংগ্রাম করেছেন বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র চিন্তাধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আজো প্রাসঙ্গিক। এমএন লারমাকে বাদ দিয়ে যেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস কল্পনা করা যায়না তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসও নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়নের সময় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে এমএন লারমা’র যে বক্তব্য তা বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে বক্তারা মন্তব্য করেন।
বক্তারা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার যে সংগ্রাম মহান নেতা এমএন লারমা বাটলে দিয়েছেন তা তাঁর দেখানে পথেই অর্জিত হবে। তাঁর প্রদর্শিত মত-পথ অনুসরণ করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মুক্তি সম্ভব। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে তা ৯৫% জুম্ম জনগণ মনে করে। সুতরাং চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সকল সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সংগঠনগুলোর পাশাপাশি তরুণ-ছাত্র সমাজকেও এই আন্দোলনে সামিল হতে হবে।
রুপালী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ
“যারা মরতে জানে, পৃথিবীতে তারা অজেয়। যে জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে জানে না, সে জাতির বেঁচে থাকার কোন অধিকার থাকতে পারে না” মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র এই অমর উক্তিকে সামনে রেখে রূপকারী ও বঙ্গলতলি ইউনিয়নের এলাকাবাসীদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির রুপালী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় চেতনার অগ্রদূত অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস ২০২৪ ইং পালন করা হয়।
গতকাল ১০ নভেম্বর ২০২৪ ইং রোজ রবিবার ভোর ৭টা ৩০ মিনিটে কালো ব্যাজ ধারণ ও অস্থায়ী শহিদ ভেদীতে মহান নেতা এম.এন লারমাসহ সকল শহীদদের স্মরণে রূপাকারী ও বঙ্গলতলি ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনসাধারণ ও রুপালী উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষক মন্ডলী, ছাত্র/ছাত্রীবৃন্দ এবং কাচালং শিশু সদনের ছাত্র/ছাত্রী বৃন্দসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বাঘাইছড়ি থানা শাখার নেতৃবৃন্দ ও অঙ্গ -সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা পুষ্পমাল্য অর্পন করেন।
উক্ত স্থানে সকাল ৯ ঘটিকার সময় ১০ নভেম্বর ২০২৪ ইং উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক বাবু বিশ্বজিৎ চাকমা (হারিহাপ্পা) এর সভাপতিত্বে এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণ সভায় শোক প্রস্তাব পাঠ করার পর মহান নেতা এম.এন লারমাসহ সকল শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়
উক্ত শোক সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি বাঘাইছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রীঃ আসেন্টু চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন- ১০ই নভেম্বর ২০২৪ ইং উদযাপন কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট কাঠ ব্যবসায়ী বাবু উদয়ন চাকমা; ৩৪নং রূপকারী ইউপি চেয়ারম্যান বাবু জেসমিন চাকমা; ৩৪নং রূপকারী সাবেক চেয়ারম্যান বাবু পারদর্শী চাকমা (পিলিক); ৫নং বঙ্গলতলি ইউপি সদস্য বাবু উষো প্রিয় চাকমা; রূপালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু ব্রহ্ম কুমার চাকমা; বাবু ভূবন কান্তি চাকমা; সাবেক ছাত্র নেতা, প্রগতিশীল চিন্তাধারার ব্যক্তিত্ব ও জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি বাবু জ্ঞান জীব চাকমা; জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি সুরেশ কান্তি চাকমা; জেএসএস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রী নরেশ চন্দ্র চাকমা।
বক্তারা বলেন, যিনি ঘুমন্ত জুম্ম সমাজকে জাগরিত করে তাদের অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার করেছিলেন। যিনি পাহাড়ে বিপ্লব শিখেয়েছেন সেই মহান নেতাকে ১৯৮৩ সালের আজকের এই দিনে জুম্ম জনগণের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে হত্যা করা হয়েছে। মহান নেতার অবদানকে তারা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। মহান নেতাকে হত্যা করে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে চিরতরে বিনষ্ট করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা তা সফল হয়নি। এমএন লারমাকে হত্যা করতে পারলেও তাঁর আদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি। বিভেদপন্থীরা যতই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে জুম্ম জনগণ ততই শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাদেরকে পরাস্ত করেছে।
১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরেরর পরও ‘৮৩ এর প্রেতাত্মারা চুক্তির বিরোধীতা করে এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের হত্যার মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অধিকারের আন্দোলনকে চিরতরে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল। বর্তমানেও সেই চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ষড়যন্ত্র জারি রেখেছে। সমগ্র জুম্ম জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সেই চক্রকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চিরতরে উৎখাত করতে হবে না হলে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বারবার তারা বিষ দাঁত বসিয়ে দেবে। ‘৮৩ এর গৃহযুদ্ধে যেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদেরকে উৎখাত করা হয়েছে আগামীতেও তাদের এমন কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে তাদেরকেও চিরতরে উৎখাত করা হবে।
একই স্থানে সন্ধ্যা ৬টার সময় অস্থায়ী শহীদ ভেদীতে মহান নেতা এম.এন লারমাসহ সকল শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উড়ানো হয়।