ভ্যানগার্ড ডেস্ক
আজ ১৩ই আগস্ট ২০২১, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বর্ষীয়ান জুম্ম রাজনীতিবিদ, সাবেক গেরিলা নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র প্রয়াত সভাপতি শ্রী তাতিন্দ্র লাল চাকমা’র (মেজর পেলে) ১ম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছরের আজকের এই দিনে সকাল ৯.১৫ টা সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফুসফুস সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি ১৯৫২ সালের, ১৬ই ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২নং বোয়ালখালী ইউনিয়নের কামুক্কোছড়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত চাকমা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মৃতঃ দেব মোহন চাকমা ও মাতার নাম মৃতঃ নন্দরাণী চাকমা। ৬ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা ও জামাতা, দুই পুত্র ও দুই নাতি সহ রেখে গেছেন অসংখ্য অনুসারী, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় দীঘিনালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৬৯ সনে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন এবং ১৯৭২ সনে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পাহাড়ি ছাত্র সমিতি’র রাজনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ১৯৭৩ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী গঠিত হওয়ার পর শান্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় এক সময় শান্তিবাহিনীতে মেজর পদে আসীন হন। তার নেতৃত্বে শত্রুদের শিবিরে চরম আঘাত হানা হতো। তার কথা শুনলে শত্রুবাহিনী তরতর করে কেঁপে উঠতো । পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র গেরিলা যোদ্ধা যিনি শত্রুবাহিনীর ৪৭ টি আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সুদীর্ঘ ২৪ বছরের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হলে তিনিও অস্ত্র সমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। চুক্তি সম্পাদনের পর তিনিও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে নিজেকে সঁপে দেন। ২০০৭ সালে এক এগারোর সময় দেশে জরুরী অবস্থা সৃষ্টি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র আজন্ম ত্যাগী, সৎ, নীতিবান ও সংগ্রামী কর্মীদের পার্টি থেকে সরিয়ে পার্টি-আঞ্চলিক পরিষদের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পায়তারা করতে থাকে শ্রীযুক্ত সন্তু লারমা। এক পর্যায়ে পার্টির সিনিয়র পর্যায়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। অগণতান্তিক, অগঠনতান্ত্রিকভাবে পার্টির সহসভাপতি, শ্রীযুক্ত সুধাসিন্ধু খীসা, শ্রীযুক্ত রুপায়ন দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত চন্দ্র শেখর চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে), ইঞ্জিনিয়ার মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা, এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা, কেন্দ্রীয় নেতা শ্রীযুক্ত বিনয় কৃষ্ণ খীসা, কেন্দ্রীয় নেতা শ্রীযুক্ত উদয় কিরণ ত্রিপু্রাসহ অনেক মধ্যম-নিম্ন সারির নেতকর্মীদের বহিষ্কার ও মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে শ্রীযুক্ত লারমা। ফলত পার্টি খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি কেন্দ্রীক বিভক্ত হয়ে পড়ে।
২০১০ সালের, ২৯-৩১ মার্চ একতরফা ও অগঠনতান্ত্রিকভাবে ৯ম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন শ্রীযুক্ত সন্তু লারমা। পার্টির নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও সমাজের সচেতন মানুষদের জেএসএসকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সকল আবেদন অবজ্ঞাভরে ঠেলে দিলেন মাননীয় লারমা। ফলত পার্টির অপর অংশও ২০১০ সালের, ১০ এপ্রিল দীঘিনালা বড়াদাম হাইস্কুল প্রাঙ্গনে এক বিশেষ কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। এতে প্রয়াত শ্রী তাতিন্দ্র লাল চাকমা সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ২০১৩ সালের ১০-১২ জুলাই ১০ম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, ২০১৭ সালের ১৭-১৯ মার্চ ১১তম জাতীয় সম্মেলনেও পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাতিন্দ্র লাল চাকমা এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৫-১৮ ফেব্রুয়ারী ১২ তম জাতীয় সম্মেলনে তিনি সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন, জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একজন অগ্রণী সৈনিক ছিলেন।