প্রতিষ্ঠার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে- কী পেয়েছে জুম্ম জনগণ?

পার্বত্য চট্টগ্রাম

সিএইচটি ভ্যানগার্ড ডেস্ক

রক্তিম চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের প্রথম প্লাটফর্ম পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যে সংগঠনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের স্বপ্ন বুনেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মেহনতি মানুষের নেতা, অধিকার বঞ্চিত জুম্ম জনগণের জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হাতে গড়া এই সংগঠন ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২, অধিকার বঞ্চিত মানুষের এই সংগঠনটি সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে। সুবর্ণ জয়ন্তীতে কি বার্তা দিবে এই সংগঠনটি? জুম্ম জনগণকে কিভাবে সন্তুষ্ট করবে, কিভাবে তাদের বিশ্বাস ও মনোবল ফিরিয়ে দেবে? এই অর্ধ শতাব্দী কি খুব কম সময়? দীর্ঘ ৫০ বছরের এই পথচলায় জুম্ম জনগণকে কি দিতে পেরেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি? কি পেয়েছে জুম্ম জনগণ? স্বভাবত এই প্রশ্ন আসতেই পারে।

জনসংহতি সমিতি’র জন্ম নেপথ্যে:

পাকিস্তান আমল:

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পাকিস্তান ও অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ভারত হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু অমুসলিম অধ্যুষিত, ভিন্ন ভাষাভাষী ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৯৭% অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন মুসলিম ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তা আজ আমরা এর মূল উদ্দেশ্য প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি “Native State” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বৃটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতি জোর দাবী জানান। এসব নারী ব্যর্থটায় পর্যবসিত হলে তাঁরা ত্রিপুরা, কুচবিহার ও মেঘালয়ের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে একটি “কনফেডারেশন” প্রতিষ্ঠার দাবী জানান। Bengal Boundary Commission এর ১৯৪৭ সালের ৮ আগস্টের স্ক্যাচ ম্যাপ শিট অনুযায়ী পাঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলার জিরা ও ফিরোজপুর মহকুমার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার কথা ছিলো। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিলো ভারতে। পরে বিভিন্ন টানা হ্যাঁচড়ার মুখে Major Billy Short এর সুপারিশক্রমে র্যাডক্লিফ ও মাউন্ট ব্যাটেন ৯ আগস্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে, জিরা ও ফিরোজপুর মহকুমার পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে গঠিত হয় অ্যাকশন কমিটি। কিন্তু রাঙ্গামাটির এই অ্যাকশন কমিটি’র আন্দোলনের স্বর দিল্লীর রাজ ভবনের দেয়াল টপকাতে পারেনি। সেই প্রতিবাদী কন্ঠস্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হবে এই আশায় স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির কোর্ট বিল্ডিং-এ ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

২১ আগস্ট বেলুচিচ রেজিমেন্ট এসে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শেষ পর্যন্ত বেলুচিচ রেজিমেন্টকে সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। এরপর থেকে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সকলকে ঢালাওভাবে ভারতপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং সেই থেকে শুরু হয় এ অঞ্চলের মানুষের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার “পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন-১৮৮১” বাতিল করেন। ফলে বিলুপ্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বাহিনী, পাহাড়ী মানুষদের আত্মরক্ষার হাতিয়ারও কেড়ে নেয় পাকিস্তান সরকার।

পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্রতা রক্ষার্থে ১৯৫৬ সালে অনন্ত বিহারী খীসা ও মৃণাল কান্তি চাকমা’র নেতৃত্বে গঠিত হয় “হিল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন” । ছাত্রদের কিছু দাবী দাওয়া ও কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয় এই ছাত্র সংগঠন। এই ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আবির্ভুত হন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদুত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ অসংখ্য জন্ম নেতা।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে এবং CHT REGULATION 1900 ACT কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জুম্ম জনগণের মরন ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শ হলে ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি তলিয়ে যায় পানির নীচে, উড়ান্ত হন ১২ হাজারের অধিক পরিবারের ৯৯ হাজার ৯শ ৭৭ জন পাহাড়ী মানুষ। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কথা থাকলেও তা সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি। “ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ” লিখেছিল, পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিপূরণের মাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল মাত্র ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার কারণে হাজার হাজার পাহাড়ী মানুষ জীবনের তাগিদে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ ও বার্মায় পাড়ি জমায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষেরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু সেই প্রতিবাদের সুর-কান্নার সুর পার্বত্য চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। বহির্বিশ্বে এই কান্নার আর্তনাদ পৌঁছেনি। এই কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৬৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের ভাে আটক হন এমএন লারমা। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ও ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ এলাকার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয়। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে স্পষ্ট উল্লেখ ছিলো যে, কোন উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার বিশেষ ব্যবস্থা যদি পুরো বা আংশিকভাবে বিলোপের প্রয়োজন হয়, তবে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট উক্ত এলাকার জনগণের মতামত নেবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত না নিয়েই বিশেষ এলাকার মর্যাদা বাতিল করেন। কাপ্তাই বাঁধের ক্ষত সেরে না উঠতেই এখানকার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন জীবনে ছন্দপতন ঘটালেন স্বৈরাচারী আইয়ুব খান। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না পারায়, ১৯৬৪ সালে প্রায় ৫০ হাজার পাহাড়ী মানুষ ভারতে পাড়ি জমান এবং প্রায় ৩০ হাজার পাহাড়ী মানুষ বার্মায় পাড়ি জমান ।।

১৯৬৫ সালের ১৮ই জুন চট্টগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে “ট্রাইবেল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন” গঠন করা হয়। ছাত্রদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া এবং কাপ্তাই বাঁধ পরবর্তী ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল এই সংগঠন। ১৯৬৬ সালে সন্তু লারমা ও অনন্ত বিহারী খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি এই সমিতি’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের মানুষদের মাঝে একটা প্রগতিশীল জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলা। ১৯৭০ সালে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে উত্থাপন করা হয় ১৬ দফা দাবীনামা । এই দাবীনামায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবী ছিল অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবী। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে এমএন লারমা বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন।

১৯৭০ সালের ১৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি সমাধানের লক্ষ্যে গঠিত হয় “রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি। আহ্বায়ক কমিটি’র প্রথম সদস্য ছিলেন এমএন লারমা, সম্ভ লারমা, ভবতোষ দেওয়ান, যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, অমিয় সেন চাকমা ও কালীমাধব চাকমা প্রমুখ। ৬৯-এর গণআন্দোলন পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এই সংগঠন প্রচারবিহীনই রয়ে যায়।

বাংলাদেশ আমল:

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক, আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সর্বোপরি এখানকার ভাষা সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয় আলাদা হওয়ায় এখানকার পাহাড়ী মানুষদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ সংরক্ষণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরপর নেতৃবৃন্দের পরামর্শে এমএনলারমা ও জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা- প্রবীণ নেতা ও ১৯৫৬ সালে গঠিত হওয়া “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি’র” প্রাক্তন সভাপতি কামিনী মোহন দেওয়ানের কাছে যান। কামিনী মোহন দেওয়ান জানান।

পাকিস্তান সরকার তাদের সংগঠন নিষিদ্ধ করেছে, সুতরাং এ নামে আর সংগঠন করা সম্ভব নয়। ফলে ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী এমএনলারমার নেতৃত্বে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতির” নাম সামানা পরিবর্তন করে রাঙ্গামাটিতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” গঠন করা হয়। এতে এমএন লারমা আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

১৯৭২ সালের ২৪ জুন রাঙ্গামাটির ইন্দ্রপুরি সিনেমা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও সাহিত্যিক বাবু বিরাজ মোহন দেওয়ান সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে ৬০ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা, সাধারণ সম্পাদক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সহ- সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন যথাক্রমেঃ হ্লাথোয়াই প্রু (হুদা), হীরলাল চাকমা, সুতকর্মা কার্বারী, বীরেন্দ্র লাল বোয়াজা, মং হ্লা চৌধুরী; যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হনঃ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সনৎকুমার চাকমা: সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রীতিকুমার চাকমা। সহ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন সুকৃতি রঞ্জন চাকমা। প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন অর্ধেন্দু বিকাশ চাকমা- সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন কংজাই মারমা, কোষাধাক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন জ্ঞানদত্ত খীসা, দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন অনাদিকুমার চাকমা: সমাজকল্যাণ সম্পাদক উহ্লাপ্রু মারমা।

জনসংহতি সমিতি’র আন্দোলন:

১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ভাবী সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীগুলোর ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণের জন্য এম এন লারমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের কাছে সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪ দফা দাবীনামাসহ স্মারকলিপি পেশ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এসব দাবী-দাওয়া বিষয়ে কুণ্ঠিত হন এবং এম এন লারমাকে এ ব্যাপারে অগ্রসর না হওয়ার আহ্বান জানান। এতে এমএন লারমা খুবই মর্মাহত হন এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যার কারণে এমএন লারম- সিহ অনেক পাহাড়ী খুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেয়া হয়নি। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় এ অঞ্চলের পাহাড়ীদের ভারতপন্থী আখ্যা নিয়ে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর আখ্যা দেয়া হলো পাকিস্তানপন্থী । প্রতিনিয়ত পাহাড়ীদের উপর চলতে থাকে স্টিম রোলার, বিডিআর, পুলিশ, সেনাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশী, রাজাকারের নাম দিয়ে গ্রেফতার, লুটপাত, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদিভাবে দমন-পীড়ন চালিয়োছিল পাহাড়ী মানুষদের উপর। এভাবে বঙ্গবন্ধুর পাহাড়ী মানুষদের দাবী প্রত্যাখান ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নিয়মত- ান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হলে এখানকার পাহাড়ী মানুষেরা অনিয়মতান্ত্রিক পন্থার দিকে এগোতে বাধ্য হয়। সামাজিক অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের উপযুক্ত প্রতিকার ও ন্যায়বিচার না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্থ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, শান্তি ফিরিয়ে আনা ও সামজিক অনাচার প্রতিরোধ, সর্বোপরি জাতিগত নিপীড়ন প্রতিরোধের মানসি- কতা থেকেই জনসংহতি সমিতি’র সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী (Peace Force) জন্য লাভ করে।

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে এক নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, “জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের আমরা সবাই বাঙালী” বঙ্গবন্ধু বাঙালী বাতিত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু পাহাড়ীদের বৃহত্তর বাঙালীদের সাথে মিশে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের প্রধানের কাছে এর চাইতে হতাশাজনক বাক্য আর কি হতে পারে। ফলশ্রুতিতে এমএন লারমা জুম্ম জাতীয়তাবাদের লোগান তুলে এ অঞ্চলের পাহাড়ী মানুষদের এককাতারে নিয়ে আসেন। তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল জুম চাষ, এই অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে এই জন্ম জাতীয়তাবাদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বাঙালী জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এই চিন্তা ভাবনা নিয়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসনে এমএন লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম-২ আসনে চাইথোয়াই রোয়াজাকে বিপুল ভোটে জয়ী করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের জনগণ। ১৯৭৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ একভাষা ও এক সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র”- এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হলে এমএনলারমা এর প্রতিবাদ জানান তিনি বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি বাংলাদেশী, কিন্তু আমার একটি আলাদা সত্ত্বা আছে, সেখানে আমি চাকমা, বাঙালি নই। “১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধানের উপর এমএন লারমা বলেন, এ সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কথা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমল হতে নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, আমাদের জাতিসত্তার কথা ভুলে যাওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা বাংলাদেশের মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে বসবাস করতে চাই। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতিসত্তার স্বীকৃতি রয়েছে। আমি সংবিধানে উপজাতীয় জনগণের অধিকার স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারের হত্যার পর সৃষ্টি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার কারণে এম এন লারমা আত্মগোপন করেন এবং জনসংহতি সমিতিকে সুসংহত করতে শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের ডেঙ সমিতি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধিদল এ অঞ্চগের সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও ও সমস্যাকে একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। যার কারণে জিয়াউর রহমান এ অঞ্চলের সমস্যাকে নির্বাসনে কালক্ষেপনের নীতি গ্রহণ করেন। ফলে জনসংহতি সমিতি ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর প্রথম সশস্ত্র আক্রমণে যেতে বাধা হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে নিয়মিত সংঘর্ষে সরকারি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। শান্তিবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময়ই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আটক হন শান্তিবাহিনীর উত্তরাঞ্চলের বিগ্রেডিয়ার ও ফিল্ড কমান্ডার স লারমা এবং দক্ষিণাঞ্চলের ব্রিগেডিয়ার ও জেএসএস নেতা চাবাই মগ।

জনসংহতি সমিতি’র আত্মকোন্দল (‘৮৩ র গৃহযুদ্ধ):

১৯৮২ সালের(২৪-২৭) সেপ্টেম্বর জেএসএসের ২য় কংগ্রেসে ইতিহাসে প্রথম ভোটের মাধ্যমে জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং সশস্ত্র পন্থায় ১ম ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চলে। কংগ্রেসের আগেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে মতানৈক্য-আভ্যন্তরীণ স্ব লক্ষ্য করা যায়, যার কারণে কংগ্রেসের পর গৃহযুদ্ধের সূচনা হ্যা। কংগ্রেসে প্রীতিকুমার বিরোধীতা না করলেও কংগ্রেসের পরপরই গোপনে নতুন একটি ৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। ভবতোষ দেওয়ানকে সভাপতি, যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে সহসভাপতি ও প্রীতিকুমার চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি করা হয়। ২৯ জন কেন্দ্রীয় সদস্যের মধ্যে ১৫ জন কেন্দ্রের পক্ষে, ১০ জন বিদ্রোহী পক্ষে, ২জন জেল বন্দী, একজন আলঙ্কারিক ও ১ জন নিরপেক্ষ ছিলেন। সভাপতি এমএন লারমা, ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা ছিলেন কেন্দ্রের পক্ষে, সাধারণ সম্পাদক ভবতোষ দেওয়ান ছিলেন বিদ্রোহী পক্ষে। জেলবন্ধি অবস্থায় সন্তু লারমা সরকারের কাছে দেয়া ৪৩ পৃষ্ঠার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে সুপারিশনামাকে প্রীতিকুমার চাকমা আপোষনামা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এবং তিনি এই আপোষনামায় পার্টির সদ গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন, যার কারণে পার্টিতে সংকট ও পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৪ই জুন ১৯৮৩ থেকে শুরু হয়ে গৃহযুদ্ধ ৩০ এপ্রিল ১৯৮৫ তে এসে শেষ হয়। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর বাদি গ্রুপের ক্যাপ্টেন এলিনের নেতৃত্বে সুইসাইড স্কোয়াডের হামলায় জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক এম এন লারমা আটজন সহযোদ্ধাসহ শহীদ হন। এরশাদ সরকার প্রথম থেকেই দফায় দফায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে থাকেন। পরিণামে গৃহযুদ্ধের প্রতিবাদে নিরাপত্তাহীন, হতাশ ও অসহায় শান্তিবাহিনীর প্রায় আড়াই হাজার কর্মী, সমর্থক ও সহযোগী সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করেন। এদের মধ্যে প্রীতি গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও মিলিটারি একাডেমির পরিচালক নলিনী রঞ্জন চাকমা( বুড়া ওস্তাদ) অন্যতম।

গৃহযুদ্ধ পরবর্তী আন্দোলন:

গৃহযুদ্ধের পর জনসংহতি সমিতি পুনর্গঠিত হতে থাকে। পুনরায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। জুম্ম নেতাদের দাবী ও সরকারের প্রচেষ্টায় সংলাপ কমিটি গঠিত হয়। সংলাপ কমিটির আহ্বায়কদের মধ্যে ছিলেন উপেন্দ্রলাল চাকমা (খাগড়াছড়ি), শান্তিময় দেওয়ান (রাঙ্গামাটি) এবং কে এস প্রু (বান্দরবান)। এই সংলাপ কমিটির মাধ্যমে ১৯৮৫ সালে ২১ অক্টোবর বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার পূজগাং-এ প্রথম সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার পুজগাং কমিউনিটি সেন্টারে। এতে জেএসএস নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে ৫-দফা দাবীনামা পেশ করেন। কিন্তু সরকার পক্ষ এই দাবীনামাকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করে পরদিনই তা ফেরত পাঠান।

১৯৮৮ সালের ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এবং এই বৈঠকে জেএসএস’র ৫ দফা দাবীনামার বিপরীতে সরকারের পক্ষ হতে জেএসএস’র কাছে ১-দফা একটি কল্পরেখ তুলে ধরা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৫ম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকেও জেএসএস নেতৃবৃন্দ -দফা দাবী নামাতেই অটল থাকেন। ১৯৮৮ সালের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর মাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে ৬ষ্ঠ বৈঠকে মিলিত হন এবং জেএসএস নেতৃবৃন্দ “আইন পরিষদ সম্বলিত প্রাদেশিক মর্যাদার দাবীর পরিবর্তে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত সংশোধিত পাঁচ লক্ষ্য মানীনামা পেশ করেন। দাবী মানামানি না হওয়ার কারণে এরপর থেকে দীর্ঘ সময় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সুস্থ জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব অর্থাৎ ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের সংহতি, সংস্কৃতি, সামাজিক গঠন, অভ্যাস, প্রথা, ভাষা প্রভৃতি এবং ভূমিস্বর অর্থাৎ পাহাড়, বন ও ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণের জন্য সর্বোপরি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং সকল প্রকারের পশ্চাদপদতা অতি দ্রুতগতিতে অবসান করিবার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের বৃহতনা স্বার্থে জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক ১৯৮৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট পেশকৃত আইন পরিষদসহ প্রাদেশিক স্বায়প্রশাসন সম্বলিত ৫ (পাঁচ) দফা দাবি সংশোধিত আকারে ৪ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৯২ পার্বত্য চট্টগ্রাম যোগাযোগ কমিটির মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট পেশ করা হয়।বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির ২৬ বারের বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা গোটা বিশ্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে সমধিক খ্যাত। সুদীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটল এই পার্বত্য ভূমিতে। সে পার্বত্য ভূমির আকাশ-বাতাস বারুদের গন্ধে মাতাল হয়ে থাকত তা আজ শান্তির দূত সাদা কপোত উড়িয়ে আশার বাণী শোনাচ্ছে। জুম্ম জনগণ আশায় বুক বেঁধেছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকবে।

শান্তিবাহিনীদের তালিকা জমাদান ও অস্ত্র সমর্পনের ক্ষেত্রে শ্রীযুক্ত সন্তু লারমার উপর অনেকখানি দোষ চাপানো হয়ে থাকে। অভিযোগ করা হয় তালিকা জমা দান ও অস্ত্র সমর্পনের ক্ষেত্রে তিনি বিপুল পরিমাণ কর্মী বাহিনীর সাথে অন্যায় করেছেন। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে আশগ্রহণ করেছেন। তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি, মিলিশিয়া বাহিনীসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র সমিতি, হিল। ইউমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের চুক্তির স্বাক্ষরের সময় বঞ্চিত করেছেন। তাদের জন্য কোন সুযোগ-সুবিধাই শ্ৰীযুক্ত সম্ভ লারমা রাখেননি।

চুক্তি পরবর্তী অবস্থা:

চুক্তির পূর্বে তৎকালীন ছাত্র পরিষদের কিছু নেতাকর্মী সন্তু লারমার সাথে চুক্তির বিষয়ে আলোচনার কথা বলা হলেও সন্তু লারমা তাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে এগোয়। যার কারণে চুক্তি স্বাক্ষরকালীন সময়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ব্যানারে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে চুক্তির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দেখা যায়। সেসব নেতাকর্মীদের সন্তু লারমা কাছে টানার বদলে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যার ফলে ইউপিডিএফ নামক দলের সৃষ্টি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন। রুপে শুরু হয় গৃহযুদ্ধের। ইউপিডিএফ নামক সন্ত্রাসীরা প্রত্যাগত নীরিহ নিরস্ত্র শান্তিবাহিনাসের উপর শুরু করল খুন, গুম, হত্যাসহ বিভিন্ন অপতৎপরতা। ফলশ্রুতিতে জনসংহতি সমিতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুললে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক ভয়ংকর অগ্নিকৃত হয়ে পড়ে। লাশের পর লাশ পড়তে থাকে এই পার্বত্য ভূমিতে। কত জুম্মা মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত নারী হয়েছে বিধবা, কত সন্তান হয়েছে অনাথ তার কোন ইয়ত্তা নেই।

চুক্তি পরবর্তী সময়ে সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদকে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে পরিণত করেন। দীর্ঘ ২৪ বছরের অধিক সম্পন্ন সংগ্রামের পর প্রত্যাগত শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ভূমিহীন, ভিটেমাটি হীন-অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে পরিবার নিয়ে যাযাবর দিনাতিপাত করেছেন। সন্তু লারমা তাদের দিকে ফিরেও তাকাননি। উপরন্তু যারা এসবের প্রতিবাদ করেছিল তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। একদিকে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু আক্রমণ অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবার নিয়ে অসহনীয় জীবনযাপন করতে হয়েছে তাদের।

এক এগারোর সময়ে দেশে জরুরী অবস্থলীন সময়ে জনসংহতি সমিতিতে আভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে উক্ত আভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে পার্টির ৮ম জাতীয় সম্মেলনের পর পরই বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে অপদ্ধতিগতভাবে সরিয়ে দিয়েছিলেন সন্তু লারমা। এরপর সরিয়ে দেয়া উক্ত নেতাদের নিয়ে সন্তু লারমা বিভিন্ন আপত্তিকর বিশেষণে বিভূষিত করে অপপ্রচার চালিয়েছিলেন। ফলে জনসংহতি সমিতির তৃণমূল পর্যায়ে বিভক্তি চলে আসে এবং পার্টির খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি কেন্দ্রীক বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠক ছাড়া একক সিদ্ধান্তে নবম জাতীয় সম্মেলনের কার্যাবলী চূড়ান্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত করেন এবং ২৯-০১ মার্চ ২০১০ একতরফাভাবে, অগঠনতান্ত্রিকভাবে সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রূপায়ন দেওয়ান, সহসভাপতি সুধাসিন্ধু শসা, সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রশেখর চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক তাতিন্দ্র লাল চাকমাকে বাদ দেন। যেখানে সম্ভ লারমা তাঁর একগেরেমি, সেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী, বল প্রয়োগের রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি ও অধঃপতিত নেতৃত্বকে প্রকাশ করেছিলেন। পার্টির এই চরম দুঃসময়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বকে প্রত্যাখান করে পার্টির সচেতন কর্মীবৃন্দ ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার বড়ানাম হাইস্কুল মাঠে এক বিশেষ কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করে এবং দীঘিনালা ঘোষণা নামে একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করে। যে ঘোষণাপত্রে সন্তু লারমার কর্তৃক অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনকে প্রত্যাখান করে ৭ সদস্যক নতুন একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত ৭ সদস্যের আহবায়ক কমিটিতে যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন শ্রী সুধাসিদ্ধ খীসা ও শ্রী রুপায়ন দেওয়ান যুগ্ম আহবায়ক, শ্রী তাতিন্দ্র লাল চাকমা সদস্য সচিব, প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা, এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা, শ্রী উদয় কিরণ ত্রিপুরা ও শ্রীমতি কাকলি খাসা।

১৯৯৭ সালের চুক্তির পর হাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংগঠন থেকে বর্তমানে চার-চারটি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে। চুি দীর্ঘ ২৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয় তা আমরা লক্ষ্য করেছি। তারপরও আমরা কেন বিভক্তির রেখা টেনে প্রতিনিয়ত ভাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রেখেছি। লাশের পর লাশ পড়ছে পাহাড়ের প্রতিটি কোণায় কোণায়। আজ অর্ধ শতাব্দি পেরিয়ে পাওয়া না পাওয়া হতাশা আক্ষেপ যেন ঘিরে ধরেছে জুম্ম জনগণকে। এমএন লারমাসহ হাজার হাজার জুম্ম সৈনিকদের আত্মবলিদানের মান আমরা দিতে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের আত্মবলিদানকে আমরা বৃথায় পর্যবসিত করে চলেছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আগামী ২০২২ সালে অর্ধশত বছরে পদার্পন করবে। এই অর্ধশত বছরে কি সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে পারবে জনসংহতি সমিতি? জুম্ম জনগণের কাছে কি জবাব দেবে সুবর্ণ জয়ন্তীতে? ৮৩র গৃহযুদ্ধ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি, যার কারণে চুক্তির পর হতে আজ আমরা ৮৩র গৃহযুদ্ধকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের গৃহযুদ্ধের ইতিহাসে অতিসম্প্রতি ঘটে চলা পরিবার উচ্ছেদের ঘটনা পৃথিবীর সকল নৃশংস ঘটনাবলীকে হার মানিয়েছে। নিজ জনগোষ্ঠীর সংগঠনের হাতে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ঘটনা যেন কাপ্তাই বাঁধের ফলে- উচ্ছেদ হওয়া ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধে ডুবে গিয়েছে ঘরবাড়ি, আর এখন নিজ জাত ভাইয়ের হাতে ভস্মিভূত হচ্ছে সেই বাড়িঘর, কি এক দুর্বিসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে জুম্ম জনগণ।

যে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বের কথা বলে এমএন লারমার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জুম পাহাড়ের এই আন্দোলন, সেই আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি আজ কোথায়? জুম্ম জনগণ সেই আন্দোলনের শুরু থেকে ইচ্ছা অনিচ্ছায় সংগঠনগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে, অথচ তাদের সেই ৫০ বছরের সহযোগীতার ফসল আমরা কি দিতে পেরেছি? এই রক্তে রঞ্জিত পার্বত্য জনপদ, হাহাকারে আর্তনাদ করা সবুজ পাহাড়, বিধবা নারীর ক্রন্দন, পিতৃশোকে কাতর সন্তান এমন জীবন ছাড়া কি পেয়েছে জুম্ম জনগণ?

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব সংগঠনগুলো সত্যিই কি এখন জুম্ম জনগণকে নিয়ে ভাবছেন? নাকি তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলে যাচ্ছেন? এর উত্তর এখন জুম্ম জনগণ চায়। সংগঠনগুলোর নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের চাইতে বহিরাগত সেটেলার বাঙালিরা সংখ্যায় এগিয়ে গিয়েছে। প্রতিনিয়ত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে ভূমি বেদখল ও জুম্ম নারীদের উপর যৌন নিপীড়নের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত উন্নয়নের নামে, ইকোপার্ক-পর্যটনের নামে জুম্মদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। আজ ২৩ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুম্ম জনগণ হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। জুম্ম জনগণের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে গিয়েছে। বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের সংখ্যা যেহেতু জুম্ম জনগণের চাইতে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সেহেতু আমাদের ঐক্যবদ্ধ যেকোন সংগ্রাম যত দেরীতে সংগঠিত হবে ততবেশী আমরা অসফল হবো। স্বাধীনতার পর যেখানে মাত্র ২৮% বহিরাগত ছিল তখন সশস্ত্র আন্দোলন করেও তেমন কিছু অর্জন করা সম্ভব হয়নি আর এখন ৫২% এর বেশী বহিরাগত রয়েছে আর আগামীতে এর সংখ্যা আরো দ্বিগুন হবে তখন কিভাবে সম্ভব হবে? সেজন্য আমাদের যতদ্রুত সম্ভব চুক্তি বাস্তবায়ন কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন ঐক্যবদ্ধভাবে জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে এগিয়ে নেয়া এবং বাস্তবায়ন করা।

সহায়ক গ্ৰন্থঃ

১) পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা – প্রদীপ্ত খীসা,

২) প্রবাহন ২০১৩,

৩) শান্তিবাহিনীর গৃহযুদ্ধ: স্বপ্নের অপমৃত্যু – উৎপল খীসা, –

৪) পার্বত্য চট্টগ্রাম: স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের সন্ধানে বিপ্লব চাকমা।

[লেখাটি জনসংহতি সমিতির ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ স্মরণে স্মরণিকা ২০২১ প্রবাহণ বই হতে নেয়া]
Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

জনসংহতি সমিতি’র ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোচনা সভা
শুরুতেই এখনো আটকে রয়েছে জুম্ম জনগণ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu