পাহাড়ের সৌন্দর্যের আড়ালে হাজারো মানুষের ভিটেমাটি হারানোর কান্না রাষ্ট্রের কাছে কবে পৌঁছবে?

পার্বত্য চট্টগ্রামমতামত

সিএইচটি ভ্যানগার্ড

রক্তিম চাকমা

ছবিঃ সংগৃহীত

মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য মানুষকে বিমোহিত করে। সেজন্য মানুষ সময়-সুযোগ পেলেই পাহাড়, ঝর্ণা কিংবা নীলাভ সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে ঘুরে আসে। বাংলাদেশের একদশমাংশ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম, টারশিয়ারি যুগের সারি সারি পাহাড় বেষ্টিত এই অঞ্চল যে কারোরি মন কাড়ে। এই অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা, সাম্রাজ্যবাদী শাসক, বিভিন্ন দেশ শাসন করেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনে কোন শাসকই এতটা মনোযোগ দেয়নি। যার কারণে এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তাগুলো দিন দিন নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসেছে। ধর্মীয় আগ্রাসন, ভূমি আগ্রাসন, সংস্কৃতির আগ্রাসন যেন এ অঞ্চলের মানুষদের উপর নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলো যেমনি সংখ্যায় অনেক কম তেমনি এ অঞ্চল ছিল পশ্চাৎপদ, তাই এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলোর জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে “শাসনবহির্ভূত এলাকা” (EXCLUDED AREA) ঘোষণা করে “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ এ্যাক্ট”( CHITTAGONG HILL TRACTS REGULATION 1900 ACT) আইন চালু করেছিল। ঐ আইনে বলা আছে যে “পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে কেউ এসে এখানে বসতি স্থাপন করতে পারবেনা, বহিরাগত কারো কাছে জায়গা-জমি বিক্রয় করতে পারবেনা”। যার কারণে তখনকার সময়ে এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সাথে যোগ হওয়ার কথা থাকলেও কোন এক অজানা কারণে পাকিস্তানের সাথে যোগ হয়। যার কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক জীবন পূর্ব বাংলার উপরই নির্ভরশীল ছিল। আর একদিক হচ্ছে পূর্ব বাংলার একমাত্র বন্দর চট্টগ্রাম নির্ভরশীল পার্বত্য অঞ্চলের উপর। আসামের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটা বা দুটো দুর্গম পথ ছিল। ফলে পূর্ব বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দুর্ভোগের কারণ হবে। আরেক তথ্যে জানা যায়, জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার বদলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কোন শাসকগোষ্ঠীই এ পর্যন্ত জনগণ চাইনি চেয়েছে ভূমি আর সম্পদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়ও একি রকম। পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরপরই ১৯৪৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ভেঙে দেয়া হয়, ১৯৫০ সাল থেকেই শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের ভূমিহীন ছিন্নমূল বাঙালীদের পুনর্বাসনের। এখানকার পাহাড়ী মানুষদের মতামতকে উপেক্ষা করে তাদের ভূমির উপর লাখ লাখ বাঙ্গালীকে সেটেল করা হয়। ষাট দশকে শুরু হয় এখানকার পাহাড়ী মানুষদের মতামত যাচাই না করে কাপ্তাই বাঁধের কাজ। উদ্বাস্তু হয় লক্ষাধিক পাহাড়ী মানুষ, কেউ ভারতের ত্রিপুরা- মিজোরামে পালিয়ে যায় কেউবা বার্মায়। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে পাক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে “শাসন বহির্ভূত এলাকা’র”(EXCLUDED AREA) পরিবর্তে ” উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল” বা TRIBAL AREA হিসেবে ঘোষণা করে। পাক সরকার পার্বত্য এলাকায় ৮লক্ষ একর রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা ঘোষণার ফলে জুম চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এই অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়ে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার একর ধান্য জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়া ও ৮ লক্ষ একর বন জমিকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণায় এই অঞ্চলের মানুষ চরম দারিদ্রতায় জর্জড়িত হয়ে পড়ে। যার ফলে পাহাড়ী নেতারা তৎকালীন পাক সরকারের কাছে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য এই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে দাবী করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে এই দাবীও আর জোড়ালো হতে পারেনি।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে এমএনলারমা’র নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪ দফা দাবী সম্বলিত স্বায়ত্তশাসন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংবিধানে প্রতিস্থাপনপূর্বক রাজাদের দফতর সংরক্ষণ ও বহিরাগত রোধসহ বিভিন্ন দাবী তোলা হলেও তৎকালীন সরকার তা উপেক্ষা করে পাহাড়ী মানুষদের বিকল্প পথ নির্বাচনে বাধ্য করে। রাজনৈতিক দল গঠন হলো, পরবর্তীতে সশস্ত্র দল এরপর সশস্ত্র সংঘাত। ৮০ দশকে পুনরায় সমতলের লাখ লাখ ছিন্নমূল বাঙ্গালীকে পাহাড়ে এনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার সর্বোপরি ১৯৯৭ সালে পাহাড়ী মানুষদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি। আজ চুক্তির ২৪টি বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে অথচ চুক্তি আজো ঝুলে রয়েছে মুলোর মত।

এমনি এক পরিস্থিতি আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে যে, একদিকে পাহাড়ী মানুষদের উপর রাষ্ট্রীয়বাহিনী ডিভাইড এ্যান্ড রুল চাপিয়ে দিয়ে অন্তর্দ্বন্ধে জড়িয়ে দিয়েছে অন্যদিকে ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণ যেন পাহাড়ী মানুষদের উপর নিত্য দিনের কাজকারবার। চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ছত্রাকের মত গজিয়ে উঠেছে পর্যটন স্পট। উন্নয়নের নামে পাহাড়ী মানুষদের ভূমি বেদখল করে একের পর এক ইকো ট্যুরিজম, রাস্তাঘাট ইত্যাদি করা হচ্ছে। স্কুল নেই, কলেজ নেই অথচ কিলোমিটার অন্তর অন্তর বড় বড় রিসোর্ট -ফাইভস্টার হোটেল। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না করে, পর্যটন কতটুকু উন্নয়ন এনে দিতে পারবে এই পার্বত্য অঞ্চলে? যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার সময়ই পাহাড়ী মানুষসহ দেশের সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে বানানো হয়েছিল বাঙালী, ২০১১ সালের ৩০শে জুন পুনরায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়া হলো! সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী মানুষদের আজো অস্বীকারই করে যাচ্ছেন অথচ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে বড় বড় হোটেল-মোটেল বানিয়ে, বড় বড় রাস্তা বানিয়ে কিভাবে বলছেন যে তাদের উন্নয়ন হচ্ছে? উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যেসব স্থানে পর্যটন গড়ে উঠেছে সেসব স্থানীয় লোকেরাতো কিছুই উন্নয়ন করতে পারেনি। হয়েছে হোটেল বয়, বেয়ারা, মেম সাহেবদের পরিচর্চার দায়িত্ব, মেথর এইসেই। আমরা সকলেই জানি পর্যটন স্পট মানেই দেহ ব্যবসার ছড়াছড়ি, দেহ নিংরে পতিতারা অর্থ উপার্জন করে সরকারকে কর দেয়। আজ পার্বত্য এলাকার পর্যটনগুলোতেও স্থানীয় মানুষদের হোটেল বয়, বেয়ারা, মেথরের কাজ করতে দেখা যায়। পাহাড়ী নারীদের সেসব পর্যটন স্পটগুলোতে দেহ ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা প্রবল হচ্ছে। তাহলে এগুলোই কি পাহাড়ের পাহাড়ীদের উচ্ছেদ করে উন্নয়ন?

আমরা পাহাড়ীরা সংখ্যাগত দিক থেকে অত্যন্ত কম, সমতলের অন্যান্য এলাকার পর্যটন স্পটের মত করে পার্বত্য এলাকাকে হিসাব করলে কিন্তু হবেনা। আমাদের পাহাড়ীদের সবকিছুর মাঝেই সর্বপ্রথম জাতীয় অস্তিত্বের কথা ভাবতে হয়, পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে- জাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। সেজন্য আমাদেরও ভয় হয় যেকোনো সময় আমরাও ডাইনোসরদের মত করে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে পারি। আমাদেরকে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিন, সাংবিধানিকভাবে আমাদের স্বীকৃতি দিন, পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বকে সুরক্ষিত রাখুন, ১৯০০ সালের শাসনবিধি পুনরায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের জন্মভূমির অস্তিত্বকে রক্ষার দায়িত্ব নিন। আমরাও যাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। যার যার মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করুন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ভূমি আগ্রাসন, ইসলামি সম্প্রসারণবাদ বন্ধ করুন, আমাদের সমাজের সামাজিক প্রথাগুলোর উপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন, প্রত্যন্ত এলাকা হতে শুরু করে সকল প্রয়োজনীয় স্থানে স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা করুন। তারপর পার্বত্য এলাকায় ইকো ট্যুরিজম হোক, ফাইভ স্টার হোটেল হোক তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবেনা, তখন আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকবে। দেশী-বিদেশী পর্যটক আসবে ঘুরবে চলে যাবে, আমাদের কোন আপত্তি থাকবেনা।

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

নানিয়ারচরে যৌথ বাহিনীর অভিযানঃ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার
বিচারহীন নৃশংস নানিয়ারচর গণহত্যার ২৮ বছর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu