প্রতিবাদ চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬টি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ২৬টি বছর আগে যে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্র আন্দোলনকামী জুম্মজনগণের সাথে চুক্তি করেছিল স্থায়ী শান্তির বার্তা নিয়ে সে শান্তি এখনও অধরায় রয়ে গিয়েছে। যেহেতু মৌলিক সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার আদৌ রাজনৈতিক সমাধান আসেনি। ফলতঃ অগ্রজদের অভিজ্ঞতা থেকে হোক বা সমসাময়িক পুস্তক-সংবাদে প্রকাশিত বাস্তবতা এককথায় ’৯৭ এর আগের বাস্তবতার সাথে বর্তমানের তফাৎ খুঁজতে চাওয়াটা অমূলক নয়।
ছাব্বিশটি বছর আগে দুই ডিসেম্বরে যে শিশুর জন্ম হয়েছিল সেই শিশুর বয়স আজ ২৬। স্বাভাবিক নিয়মে হিসেব করলে ২৫-২৬ বছরের সেই তরুণ ইতিমধ্যে স্নাতকোত্ত্বর শেষ করে তাঁর জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হুওয়ার বয়স, ছোটবেলা থেকে বুনা স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বয়স। ছাব্বিশটি বছর অনেক বড় সময়, এই সময়ে স্নাতকোত্ত্বর শেষে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হওয়ার বা পরিগণিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের কথা। তাহলে যে উদ্দেশ্যে এই চুক্তি সম্পাদন সেটি লাভের পর আরও অধিকতর ভালো কিছু হওয়ার বাঁ পাওয়ার এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে আমরা আশা করতেই পারতাম!
কবির ভাষায় বলতে হয় – কথা অনেক ছিলো, কেউ কথা রাখেনি, ২৬টি বছর পরেও আকাঙ্ক্ষিত শান্তির সুবাতাস মিলেনি। আজো প্রায় সময়ে সময়ে বুট জোড়ার প্রতিধ্বনি পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে শুনা যায়, আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা তথাকথিত আইনের রক্ষকের লালসার শিকারের খবর আসে, আজও ভূমি হারানো, বাড়ি হারানো কোন পিতার, কোন মায়ের, কোন ভাইয়ের আর্তনাত শুনা যায়। থামেনি বঞ্চনা, নিপীড়ন। এরই মাঝে রাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে বুক ফুলিয়ে অসত্য এবং মনগড়া বক্তব্য দিয়ে আসে সে যেন হয় এ সকল চির বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষদের সাথে এক চরম উপহাস!
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে যে দলটি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল বা তারও আগে যদি বলতে হয় যে দলটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সেই দলটি বিগত প্রায় ১৫টি বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন সেই দলটি ২০১৪ সালের পর থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া একেবারে বন্ধ রেখেছে। উপরন্তু অভিযোগ রয়েছে চুক্তির পর থেকেই রাষ্ট্রেরই কোন এক বা একাধিক শাখার ইন্দনে জুম্ম জনগণের ঐক্য বিনস্ত করার-বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে, চুক্তি বিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়েছে-দিচ্ছে। স্বাধীন দেশেও তাই কেউ কেউ ৩০ মিনিটে সমস্যা সমাধান করার স্পর্ধা দেখিয়ে যেতে পারেন। যদিও পরবর্তীতে এই স্পর্ধা মাটিতে মিশে গিয়েছে বলে ঘটমান বাস্তবতায় প্রতীয়মান হয়েছে। যে ১৯০০ সালের শাসনবিধির উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, যে শাসনবিধি এখনও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রীয় মদদে একটি পক্ষ সেই শাসনবিধিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলার পায়তারা করে চলেছে।
পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়নি, বরঞ্চ অবাধে ভূমি বেদখল, ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়নের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের নামে হাজার হাজার একর ভূমি ও পাহাড় বেদখল ও অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সমন্বয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হলেও এখনো চুক্তি পূর্ব সময়ের মতো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এসব কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলছে। ফলে জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা; নির্বাচন বিধিমালা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নপূর্বক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখল হওয়া জায়গা জমি জুম্মদের নিকট ফেরৎ দেয়া; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গায় জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথ পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট; পুলিশ রেগুলেশন, ১৯৭২ সালের বন আইন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন প্রদান করা ইত্যাদি।
পার্বত্য চুক্তি অবাস্তবায়িত থাকায় সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। চুক্তির পর থেকে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের মনোনীত সদস্যদের দিয়ে জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত করেছে। যে জেলা পরিষদ জুম্ম জনগণ তথা গোটা স্থায়ী পার্বত্যবাসীদের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্র বিন্দু তাতে অনির্বাচিত ও দলীয় সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চাকুরী নিয়োগ ও বদলী, খাদ্যশস্য বরাদ্দ তসরুপ বা আত্মসাৎ, উন্নয়নমূলক কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাম্প্রতিক প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ণের মাধ্যমে জেলা পরিষদে জন প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ইলেকশন না হয়ে সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সিলেকশনের মাধ্যমে পরিষদ পরিচালিত হওয়ার কারণে পার্বত্যবাসীর আশা-আজাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এত বছরেও প্রতিফলিত করতে পারেনি।
চুক্তি স্বাক্ষরের এই দিনটিতে একদিকে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ নিয়ে ব্যান্ড প্রোগ্রামসহ লোকদেখানো, মনভুলানো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্দোলনকে বাঁধাগ্রস্ত করতে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্তের সকল বন্দোবস্ত করা হচ্ছে অপরদিকে শত বছরের বঞ্চনার গ্লানী নিয়ে আমরা করে চলেছি অস্তিত্ব রক্ষার নিরন্তর সংগ্রাম। যার ধারাবাহিকতায় দেশব্যপী বিভিন্ন উদ্যোগ বা আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকারের পক্ষে সরব জানান দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সিদ্ধান্ত আপনার – আপনি কি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে গা ভাসাবেন নাকি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামীল হয়ে নিজেদের জাতীয় অস্তিত্ব তথা জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার একজন গর্বিত সৈনিক হবেন!!
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচনার বিষয় ইজরায়েল এবং হামাসের চলমান যুদ্ধ। ইতিহাস বলে বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করেছিল জায়নবাদী ইহুদী সেটেলারেরা। অন্যান্য স্থানে নিপীড়িত হিসেবে প্রথমদিকে জায়নবাদীরে ভালোভাবেই গ্রহণ করা হয়েছিল বা সেই সময়ে ফিলিস্তিনীদের সাথে সংঘাতময় পরিস্থিত ছিল না বরং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। কিন্তু যাদেরকে মানবিক দিক বিবেচনা করে স্থান দেওয়া হয়েছিল সেই জায়নবাদীরাই বর্তমানে ফিলিস্তিনীদের উপর নির্যাতন করে চলেছে। রাষ্ট্র বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি এমনকি অতিসম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আইনি লড়াইয়ে অন্যতম পক্ষ হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছে। নির্যাতনের বিপক্ষে এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দায়িত্ব ঠিকই কিন্তু বহু দূরের ফিলিস্তিনীদের জন্য যে দরদ এই রাষ্ট্রের রয়েছে সেই একই দরদ নিজের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের জন্য পরিলক্ষিত হয় না যা পার্বত্যবাসীদের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যে ইজরায়েলী সেটেলমেন্টের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান সেই একই কাজ একই রাষ্ট্র নিজের দেশেই করে চলেছে ……
ফিলিস্তিনীদের উপর দীর্ঘ প্রায় দুই মাস ধরে ইজরায়েলী বাহিনীর বর্বরতা চলছে। এতে অগণিত শিশু, মহিলাসহ সাধারণ জনগণের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ফিলিস্তিনের জনপথ। কিন্তু তথাকথিত ফিলিস্তিনের অভিভাবকের দায়িত্ব পালনরত মাহমুদ আব্বাসকে এই নির্মমতার বিরুদ্ধে জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু অনেকক্ষেত্রে অধিকারের জন্য লড়াইরত হামাসসহ অন্যান্য লড়াকু সংগঠনগুলোকে অসহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া যায়। যদিও অনেক পরে হলেও অতিসম্প্রতি এই অসম এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ফাতাহও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে তরুণ প্রজন্মের করনীয় কি?
যেহেতু ৯৭ সালের সেই শিশুটিরও এখন সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ২৬টি বছর ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পরার সময় এসেছে তাই এখনই সময় কালক্ষেপণ না করে নিজেকে, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে কারও আশায় না থেকে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করার। আমাদের বাবা দাদারা লড়াই করার ভীত রচনা করে গিয়েছেন, শিখিয়ে গিয়েছেন যারা লড়াই করতে জানে তারা পৃথিবীতে অজেয়। তাই অগ্রজদের এই শিক্ষাকে বুকে ধারণ করে মরণপন লড়াইয়ে এগিয়ে আসার, হাল ধরার এখনই সময়। কেননা “ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে লড়াই করে বাঁচতে শেখা শ্রেয়”।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।