নানিয়ারচর গণহত্যার ৩১ বছরঃ প্রসীত বিকাশ খীসা ও তাঁর অনুগামীদের একঘেয়েমিই দায়ী

পার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

সিএইচটি ভ্যানগার্ড ডেস্ক

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের বিষাদময় ইতিহাসে নানিয়ারচর গণহত্যার ঘটনা এই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর এক নতুন সংযোজন বলা চলে। রাঙ্গামাটি থেকে ২০ মাইল উত্তরে হ্রদ বেষ্টিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচরের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে পানির পথ। লঞ্চঘাটের একমাত্র যাত্রী ছাউনিতে দীর্ঘদিন ধরে ৪০ ইবিআর, সেনাবাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ যাত্রীদের নিয়মিত তল্লাশির নামে হয়রানি-নির্যাতন চালানো হতো। এখানে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ী বৌদ্ধ নারীদের উত্যক্ত করতো দীর্ঘ দিন ধরে। ২৭শে অক্টোবর পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নানিয়ারচর থানা শাখার সম্মেলন শেষে খাগড়াছড়িগামী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দকে আটকে রেখে হয়রানি, নির্যাতন চালানো ও নেতৃবৃন্দকে খাগড়াছড়ি পায়ে হেটে যেতে বাধ্য করা হয়। তাই পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র সমাজ হয়রানি, আটকের প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবীতে সোচ্চার হয় এবং বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে।

ঘটনার নেপথ্যে : নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, ২রা নভেম্বর ১৯৯৩ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ যাত্রী ছাউনি থেকে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহারের সময় বেঁধে দেয় ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। দিনটি ছিল বুধবার, নানিয়ারচর (নান্যেচর) এর সাপ্তাহিক হাটবাজারের দিন। তাই স্বাভাবিকভাবে দুর-দূরান্ত থেকে বাজারে এসেছিল শত শত জুম্ম শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ। ১৭ নভেম্বর যেহেতু ছাত্রদের বেঁধে দেয়া শেষ সময়, তাই ছাত্ররা সেই দিন বেলা ১২ টায় মিছিলের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ছাত্রদের সাথে যোগ হয় জনতাও। ঠিক বেলা ১২ টায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে মিছিলটি স্থানীয় লাইব্রেরী প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়। যাদের প্রধান দাবীগুলো ছিল- যাত্রী ছাউনি থেকে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহার, পিসিপি’র (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ) ৫দফা দাবী মানাসহ গণধিকৃত জেলা পরিষদ বাতিলের দাবী। কয়েক হাজার পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে স্লোগানে উজ্জীবিত মিছিল থেকে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবী উচ্চকন্ঠে জানানো হচ্ছিল। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে কৃষি ব্যাংক এর সামনে সমাবেশ করে। অন্যদিকে বাঙ্গালী অনুপ্রবেশকারীদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদও একটি জঙ্গী মিছিল বের করে। তারা মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান তুলতে থাকে। এক পর্যায়ে সেটেলার গণপরিষদের মিছিল থেকে হামলা করে এক বৃদ্ধ পাহাড়ী বৌদ্ধকে আহত করা হয়। এতে করে জুম্মদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এক পর্যায়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনী ও সেটেলাররা। ফলে ঘটে যায় বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে সংঘটিত এই বর্বরোচিত গণহত্যায় ২৯ জন জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ নিহত হয়, আহত হয় শতাধিক।

অভিযোগ করা হয়, নানিয়ারচরের এই গণহত্যার পেছনে তৎকালীন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ’র সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসার উগ্রতা, ব্যক্তিগত আক্রোশ ও একঘেয়েমিই দায়ী ছিল। উল্লেখ্য যে, নানিয়ারচর বাজারের যাত্রী ছাউনিকে সেনাবহিনী সেনা চৌকিতে পরিণত করে। ফলশ্রুতিতে নিরীহ পাহাড়ীদের প্রতিনিয়ত হয়রানি ও তল্লাশীর স্বীকার হতে হত। ২৭শে অক্টোবর ছিল পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, নানিয়ারচর থানা শাখার সম্মেলন, সম্মেলন শেষে পিসিপি’র নেতৃবৃন্দরা খাগড়াছড়ি ফেরার সময় উক্ত সেনা ছাউনিতে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ও প্রসিত খীসাদের মধ্য কথা কাটাকাটি হয়। প্রসিত খীসা এই কথা কাটাকাটিকে ব্যক্তিগত আক্রোশে পরিণত করেন। পরবর্তীতে সেই যাত্রাী ছাউনী থেকে সেনা চৌকি সরানোর জন্য বৃহত্তর জনসমাবেশের ডাক দেয়া হয় পিসিপি’র পক্ষ থেকে। কিন্তু এই সমাবেশটি যেদিন ডাক দেওয়া হয়, সেদিন ছিল হাটবার। নানিয়াচর উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাহাড়ীরা তাদের জুমে উৎপাদিত ফসল বিক্রির উদ্দেশ্যে নানিয়ারচর বাজারে আসতে থাকে।

এদিকে, উক্ত সমাবেশকে ঘিরে সেনা-সেটেলার ও স্থানীয় পুলিশ বাহিনীরা সতর্ক অবস্থানে ছিল এবং আগে থেকেই তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ছিল। ফলে তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে সেটেলারদের জড়ো করতে থাকে। ঘটনা বেগতিক দেখে স্থানীয় পিসিপি’র কর্মীরা প্রসিত-রবিশংকরদের বারবার জানিয়েছিল, পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। ১৫ নভেম্বর নানিয়াচর পিসিপি’র পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, নানিয়াচরের অবস্থা থমথমে- সমাবেশ করলে সংঘর্ষ অনিবার্য। যদি সমাবেশ স্থগিত করা না হয়, তাহলে বড় ধরণের কোন ঘটনা ঘটতে পারে বলেও স্থানীয় পিসিপি’র পক্ষ থেকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়। পিসিপি’র অনেক ছাত্র নেতা বিষয়টি সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে বলেন যে, কেবল নানিয়ারচরের যাত্রী ছাউনি সেনামুক্ত করলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন চলে যাবে না। পিসিপি’র লড়াই কেবল আংশিক নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনামুক্ত করা। কিন্তু প্রসীত বিকাশ খীসারা তা শোনেননি! সে কারণে এই হত্যাকান্ডের পেছনে অনেকেই প্রসীত বিকাশ খীসার একঘেয়েমি ও তাঁর অনুগামীদের দায়ী করেন।

প্রসীত বিকাশ খীসা ব্যাক্তিগত অপমানের জ্বালায় এতটাই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে, নিজের অপমানের জ্বালা মিটাতে অজস্র জুম্ম জনগণের সামগ্রিক অবস্থাকে বিবেচনায় না নিয়ে সমাবেশ করার দাবিতে অনড় থাকেন। ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের পাতায় ঘটে গেলো আরো এক হৃদয়বিদারক গণহত্যা। মিছিল শুরু হলে সেনাবাহিনীরা সেটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ সেটেলারদের লেলিয়ে দিয়ে বাজারে আসা এবং আসতে থাকা পাহাড়ীদের উপর চালানো হয় হত্যাকান্ড।

ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি : ১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে সংঘটিত এই বর্বর গণহত্যায় ২৯ জন নিহত হয় এবং জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ, আহত হয় শতাধিক। এই জঘন্য বর্বর গণহত্যায় সেনাবাহিনীর বন্দুক গর্জে উঠেছিল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মিছিলে, সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ইশারায় সেদিন ধারালো দা, বর্শা, বল্লম নিয়ে নানিয়ারচর বাজারে আগত নিরীহ জুম্মদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বগাছড়ি, বুড়িঘাট থেকে আগত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী সেটেলাররা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল জুম্মদের ২৭টি বসত বাড়ি। নানিয়ারচর বাজারে জুম্ম ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বাঙালি সেটেলার ও সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই বর্বর গণত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটেলারদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদের নেতা ও প্রাক্তন বুড়িঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আয়ুব হোসাইন, তৎকালীন বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, নানিয়ারচর জোনের জোন কমান্ডার মেজর সালাউদ্দিন।

জুম্ম ছাত্ররা যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে তখন সেনা ক্যাম্প হতে জুম্ম ছাত্রদের উপর এলোপাতারিভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়। এক পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী বাঙালীদের মিছিল থেকে দা, বল্লম ইত্যাদি দিয়ে হামলা হলে জুম্ম ছাত্র সমাজ জনতাকে নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ করে। এতে সেটেলার বাঙ্গালীরা পিছু হটলে কর্তব্যরত আর.পি ল্যান্স নায়ক জুম্ম জনতার উপর ব্রাশ ফায়ার করেন। এতে মূর্হুতের মধ্য ৮জন জুম্ম ছাত্র শহীদ হন। গুলিতে আহত হন অনেকে। এতে জুম্মদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হওয়া জুম্মদের উপর ঝাপিয়ে পরে সশস্ত্র সেনাবাহিনী ও বাঙালী সেটেলাররা। সেনাবাহিনীর বন্দুকের আঘাতে মূর্মুষ করার পর কাপুরুষেরা অনেককে পশুর মত জবাই করেছে। অনেকে কাপ্তাই লেকের পানিতে ঝাঁপিয়েও প্রাণ বাচাঁতে পারেনি। জেট বোট ও নৌকার উপর থেকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনেককে। যারা পাহাড়িদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল তাদেরকে টেনে হিচড়ে বের করে হত্যা করা হয়েছে অথবা পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশের জুম্ম গ্রামগুলি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সময় রাঙ্গামাটি থেকে আসা লঞ্চ পৌঁছালে সেখানেও হামলা করে অনেককে হতাহত করা হয়। এতে ভদ্রীয় নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেন। এভাবে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় জুম্মদের উপর।

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঢাকায় মিছিল: নানিয়াচর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ঢাকায় মৌন মিছিল করেন। এটি ছিল পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের রাজধানীর বুকে প্রথম মৌন মিছিল। এ মৌন মিছিলে অংশগ্রহণকারী এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেন, এ হত্যাকান্ডে শ্রীমৎ ভদ্রীয় মহাথের নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু গুরুতর আহত হন। তখন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি পদে ছিলেন শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের। এ মৌন মিছিলে প্রায় তিনশত জন বৌদ্ধ ভিক্ষু অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় শহীদ মিনার হতে প্রেসক্লাবে গিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সভার মাধ্যমে শেষ হয়। এ সংক্ষিপ্ত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে ভিক্ষুসংঘ হতে শ্রীমৎ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে বক্তব্য প্রদান করেন। তিন পার্বত্য জেলা হতে ঢাকার বুকে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ মিছিলে অংশ গ্রহণ করে। শান্তপ্রিয় বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, এই গণহত্যার হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও সরকারে পক্ষ থেকে নিহত ২০ জন বলে জানানো হয়েছিল। সেই সময়ের পত্রিকা মারফত এই সংখ্যাকে ২৭ বা তারও বেশী বলে দাবী করা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী জুম্মরা এই সংখ্যা শতাধিক বলে জানিয়েছেন। যেহেতু ঘটনার পর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল, তাই প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ বার বার উঁকি মারে। গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এই সব মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ বার বার প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে পার্বত্যঞ্চলের সামরিক, বেসামরিক, প্রশাসক ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা।

তথ্যসূত্র: (১) জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন নং- ১৫,৩য় বর্ষ, শুক্রবার, ৩১শে ডিসেম্বর,১৯৯৩ ইং। (২) সিএউটিবিডি ডটকমনেট, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা” ০৯ নভেম্বর, ২০১১ইং। (৩) জনকন্ঠ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং । (৪) প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৫) দৈনিক পূর্বকোণ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৬) দৈনিক আজাদী, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং ।

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

বাঘাইছড়িতে পৃথক পৃথক স্থানে এমএন লারমা’র মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu