চীনকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, মৃত্যু কমানোর উপায় কী?

দেশ

অনলাইন ডেস্ক

ছবিঃ প্রতীকী

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৩ জন। এর আগে সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ২৬ জন মারা গেছেন বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। আর এর মধ্য দিয়েই করোনায় মৃতের সংখ্যায় চীনকে (চার হাজার ৭৩৪) ছাড়ায় বাংলাদেশ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত করোনাতে মোট মারা গেলেন চার হাজার ৮০২ জন। গত ১৩ জুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাতেও চীনকে ছাড়ায় বাংলাদেশ। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনার আপডেটে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২৮তম।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়। বাংলাদেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু হয় ২১ জানুয়ারি। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়। আর করোনায় প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় তার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ। করোনাতে সোমবার ২৬ জনের মৃত্যু ছিল গত ৪৩ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত দুই আগস্ট ২৪ ঘণ্টায় ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল অধিদফতর। আর দেশে একদিন সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হয় গত ৩০ জুন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুসারে, সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃতের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাতে কেন এবং ঠিক কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যু হচ্ছে তার পর্যালোচনা দরকার, তাতে অন্তত কিছু মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো বা হবে। একইসঙ্গে মৃত্যু কমানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (১৫ সেপ্টেম্বর) মারা যাওয়া ৪৩ জনের মধ্যে ষাটোর্ধ্বই রয়েছেন ৩২ জন। শুরু থেকেই করোনায় আক্রান্ত হওয়াদের মধ্যে ষাটোর্ধ্বদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে এসেছেন সংশ্লিষ্টরা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য জটিল অসুখ।

অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত মোট মারা যাওয়াদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব দুই হাজার ৪১৭ জন ছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছেন এক হাজার ৩০৬ জন (২৭ দশমিক ২০ শতাংশ), ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ৬২৩ জন (১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ), ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ২৮৫ জন (পাঁচ দশমিক ৯৪ শতাংশ), ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ১০৯ জন (দুই দশমিক ২৭ শতাংশ), ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ৪১ জন (শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ) এবং শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে রয়েছে ২১ জন (শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ)।

সম্প্রতি, মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী স্বীকার করে দেরিতে হাসপাতালে আসাকে কারণ হিসেবে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, আমরা বলছি, যদি শ্বাসকষ্ট না থাকে, অন্যান্য জটিলতা না থাকে তাহলে হাসপাতালে আসার দরকার নেই। কিন্তু যাদের কোমরবিড ইলনেস যুক্ত (যেমন ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসার অথবা এমন কোনও রোগ রয়েছে যে জন্য তাকে স্টেরয়েড খেতে হয়) এসব রোগী কোভিডে আক্রান্ত হলে তাদের বাসায় রাখা যাবে না। কারণ, এসব রোগীর এক্সট্রা সাপোর্ট দরকার হয়, যেগুলো বাড়িতে দেওয়া সম্ভব নয়।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে বৃদ্ধ এবং অন্যান্য জটিলতা রয়েছে। তাদেরকে চেষ্টা করেও বাঁচানো যাচ্ছে না।

দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর দিকে ধীরে ধীরে হলেও মে মাসের মাঝামাঝিতে এসে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে, জুনে এসে তার অবনতি হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মৃত্যু। তবে গত সোমবার একদিনে ২৬ জনের মৃত্যুকে কোনোভাবেই মৃত্যুর হার কমছে বলে ধরে নিচ্ছে না বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠন করা পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি করোনাতে মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে বলেছিল, করোনাতে শূন্য মৃত্যুর টার্গেট নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এজন্য গত ১৭ জুন তারা একটি লিখিত প্রতিবেদন দেয়, যেখানে কাজটি কীভাবে করতে হবে তার কিছু দিক-নির্দেশনা ছিল।

রিস্ক গ্রুপকে যদি ‘প্রটেক্ট’ না করা যায় তাহলে মৃত্যু বাড়তেই থাকবে মন্তব্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা বৃদ্ধ এবং যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ বা সিওপিডি, লিভার-কিডনি রোগে আক্রান্ত, ক্যানসার আক্রান্ত, স্থূলকায় এ ধরনের মানুষদের ‘প্রটেক্ট’ করতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই তিন হাজার কনফার্ম রোগীর ভেতরে ৪০০-এর বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে ডা. ফরহাদ উদ্দিন বলেন, এর বাইরে সাসপেক্টেড কেস রয়েছে। আর কিছু উদ্যোগ নিলে মৃত্যুহার কিছুটা হলেও কমানো যেতো মন্তব্য করে তিনি বলেন, একইসঙ্গে ‘প্রি হসপিটাল কেয়ার’-এর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ এসব রোগীর অবস্থা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যায়নি, ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হয়।

তিনি বলেন, এখন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে যায় না, শুরু থেকেই বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেবার বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে—আর এ বিষয়টা মানুষের মাথায় গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু ক্রিটিক্যাল হয়ে গেলে বাসায় চিকিৎসা সম্ভব নয়। এই রিস্ক গ্রুপটার জন্য সরকারি উদ্যোগে একই জায়গা থেকে একই চিকিৎসক ফোন করা যায়, কারণ তারা অ্যাসেস করতে পারে, কোন রোগী খারাপ হয়ে যাবে, তাহলে সে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে অক্সিজেন কমে যেতে থাকলে বাসায় অক্সিজেন ট্রাই করবে না—এসব উদ্যোগ নিলে হয়তো কিছুটা মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।

ঢামেকে মোট ভর্তি ছিল আট হাজার ৭০০ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন।মৃত্যু কমিয়ে আনতে আমাদের কিছু রিকমেন্ডেশন ছিল জানিয়ে পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পাবলিক সেক্টরের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে, অনেকের জন্য সেটা সহজও হয় না, তাই প্রাইভেটের প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু এখান থেকে রিপোর্টিংটা সরকারকে কারেক্টলি করছে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া হচ্ছে না, বিশেষ করে মৃত্যুর ক্ষেত্রে। আবার অনেকেরেই হয়তো ইমিডিয়েট কোভিডের কারণে মৃত্যু না হলেও পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশনের কারণে মৃত্যু হচ্ছে। কোভিড কলেরা বা ডায়রিয়ার মতো সিঙ্গেল এপিসোড নয়—এর অনেক জটিলতা রয়েছে, এটা ক্রনিক ডিজিজের সঙ্গে অন্যান্য রোগ যুক্ত হয়েই মৃত্যু হচ্ছে বয়স্কদের। অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, আরেকটু গুরুত্ব আর উদ্যোগ নিলে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা যেতো।

কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মৃত্যু কমানোর জন্য আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া উচিত, ডেথ সার্ভিলেন্স শুরু করা উচিত। যাতে করে মৃত্যু সম্পর্কে খুব বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, আমরা করোনায় মৃত্যুকে এত স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছি—একে ধর্তব্যের ভেতরেই আনছি না। অথচ সংক্রমণ চলছে এবং সেই সংক্রমণে যারা ‘হাই রিস্ক পপুলেশন’ তারাই মারা যাচ্ছেন। সংক্রমিতদের নিয়মিত ভিত্তিতে ঘনঘন ফলোআপ করতে হবে। তাদের মধ্যে আবার ‘সিরিয়াস ইল’ যারা আছেন তাদেরকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা-পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই ধারাবাহিকতাতেও যদি একজন মানুষকেও বাঁচানো যায়, সেটাই হবে সার্থকতা।

সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

নোবেল শান্তির জন্য মনোনীত বাংলাদেশি চিকিৎসক রুহুল আবিদ।
করোনাভাইরাস: ভারতে শনাক্ত রোগী ৫০ লাখ ছাড়াল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu