চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ৫ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ (৯ই মার্চ ২০২৫) সকাল ১০.০০ ঘটিকার সময়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ের বৈঠকখানা মিলনায়তনে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হোন” প্রতিপাদ্যে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বে আসছেন দীপন চাকমা এবং কেলিন চাকমা।

এর আগে চট্টগ্রাম মহানগর শাখার বিদায়ী কমিটির সদস্য ছাত্র নেতা নিঝুম চাকমার সঞ্চালনায় ও পিসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার বিদায়ী কমিটির সদস্য দীপন চাকমার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ( সিপিবি) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক নূরছাফা ভূইয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি সভাপতি সুজন চাকমা; সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি মিরাজ উদ্দিন ; বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শুভ দেব নাথ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সদস্য শায়েন্ত চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সুনয় চাকমা; আদিবাসী শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি নিখিল চাকমা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ৯০ এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের মাধ্যমে পাহাড়ের তরুণ-ছাত্র সমাজ রাজপথে নিজেদের দাবী-দাওয়া নিয়ে সরব হয়েছিল। সেই ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে সংগঠিত লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ মে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম হয়েছিল। সেই থেকে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আজো লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের দাবীতে আন্দোলনের পাশাপাশি কুসংস্কারচ্ছন্ন জুম্ম সমাজকে পরিবর্তন তথা পশ্চাৎপদ জুম্ম সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসমূহের মধ্যে বৈষম্য দূর করে জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কাজও এই ছাত্র সমাজকে করতে হবে। যুগে যুগে ছাত্র-তরুণ সমাজই একটি জাতিকে, একটি দেশকে দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছে। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণ আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২৪ এর গণভ্যুত্থান সবখানেই ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি যেকোনো সময়ের তুলনায় অত্যন্ত নাজুক। উন্নয়নের নামে সন্ত্রাসী দমনের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করে বন উজার করে পরিবেশকে রুক্ষ করে তোলা হচ্ছে। জুম্মদের তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বান্দরবানে কেএনএফ দমনের নামে পুরো কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীর উপর কালো থাবা বসানো হয়েছে। কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর লোকেরা হাট-বাজারে আসতে পারছেনা, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়ারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছেনা। ঘর থেকে বের হলেই রাষ্ট্রীয়বাহিনী কর্তৃক সাধারণ কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর লোকেরা নানা ধরণের হয়রানি, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতারের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়বাহিনীর ধরপাকড় ও নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের মিজোরাম এবং বার্মায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মলীকরণের যে ষড়যন্ত্র তা বাস্তবায়নে আরেক ধাপ এগিয়েছে বলে ব্যক্ত করেন বক্তারা।
বত্তারা আরও বলেন, জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামেও তরুণ এমএন লারমারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জুম্ম জনগণের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র আন্দোলনের ফসল ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আজকে ২৭টি বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের বিধিমালা চুড়ান্ত হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার নিরসন করার কথা থাকলেও তা এখনো অধরা রয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে উন্নয়নের নামে পর্যটনসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে জুম্মদের ভূমি অধিগ্রহণ করার পায়তারা প্রতিনিয়ত বাস্তবায়ন হতে চলছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে ভূমি সমস্যা জিইয়ে থাকলেও সে সমস্যা চুক্তি মোতাবেক সঠিক সমাধান সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তরিক সদিচ্ছা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহের নির্বাচনের বাধ্যবাদকতা থাকলেও দীর্ঘ ২৭ বছরেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনির্বাচিত ও সরকার দলীয় সিলেক্টেড ব্যক্তিদের দ্বারা পরিষদগুলো পরিচালিত হওয়ার কারণে অনিয়ম, দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে আদিবাসী কোটা বাতিল করার ফলে সরকারী চাকুরীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফলতঃ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র কর্তৃক আরও বেশী পেছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। চুক্তি মোতাবেক স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর কথা থাকলেও এখনো মাত্র তিন জাতিগোষ্ঠীর (চাক্কা, মারমা, ত্রিপুরা) ভাষা-ভাষীদের তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বই বিতরণ করা হয়েছে। এসব বই বিতরণ করা হলেও এসব ভাষায় শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ছাত্র ও যুব সমাজের এগিয়ে আসা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। জুম্ম জনগণের প্রাণের দাবী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও আত্মত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে সকল মান-অভিমান ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে বিপ্লবী ভূমিকা রাখার জন্য সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও সংগ্রামী আহ্বান জানান বক্তারা।
সম্মেলন থেকে পুরাতন কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে, দীপন চাকমা’কে সভাপতি, কেলিন চাকমা’কে সাধারণ সম্পাদক ও শায়েন্ত চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখা নতুন গঠন করা হয়।