সিএইচটি ভ্যানগার্ড
গোমতি গণহত্যার ৪২বছর আজ। ১৯৮১ সালের ২৬জুন শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার গোমতি ইউনিয়নে তৎকালীন সেনা শাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সেটেলার বাঙালীরা জুম্মদের উপর গণহত্যা চালায়।
সেদিন সেটেলার বাঙালীরা আল্লাহ তাকবির স্লোগান দিয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে বেলছড়ি, বৈরাগীছড়া ত্রিপুরাপাড়া, ডাংগি পাড়া, মানিক হাবিলদার পাড়ার গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালায়। হামলায় ৫০০ এর অধিক জুম্মকে হত্যা ও গুম করা হয় এবং প্রায় সাড়ে চার হাজার জুম্ম পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
জানা যায় গুমতি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও হেডম্যান ছিলেন যোগেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, তাদের গ্রামের পাশে ৩০০/৪০০ জন সেটেলার বাঙালী পরিবারের চৌদ্দগ্রাম নামে একটা গ্রাম ছিল। রাতে সেই গ্রামের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নেয় ৬০০-৭০০ মতো জুম্ম পরিবার। ভয়ে-আতঙ্কে সারা রাত কাটিয়ে ভোর হবার পর পরদিন সকালে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে মনে করে যোগেন্দ্র হেডম্যানের কথায় সবাই গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামে ফিরেছে খবর শুনে সেটেলার বাঙালীরা আবারও হামলা করতে যায়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের সেটেলার আজিজ এর নেতৃত্বে ১০০-১৫০ জন সেটেলার বাঙালী সীমান্ত পার করিয়ে দেয়ার ওয়াদা করে সবাইকে জঙ্গলের দিকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর সবাইকে জোড়া করে বেঁধে ফেলা হয়। এদিকে ডিসি এবং ইউএনও গুমতি বাজার পরিদর্শনে যান এবং বাজারে আটক হওয়া ৫/৬ টি গ্রামের লোককে দেখে ফিরে যান। এর পরে শুরু হয় আসল তান্ডব। সেটেলার আজিজের নেতৃত্বে জঙ্গলে জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে রাখা সকল জুম্মকে ধারালো দা দিয়ে একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন গর্ভবতী নারী ছিলেন। তাদেরকে গোপনে বেলছড়ি-বেলতলী সীমান্ত পার করিয়ে নিয়ে যায় কিছু সেটেলার। এ গণহত্যায় মারা যায় প্রায় ৭০০ সাধারণ জুম্ম।
সুইচালাং কুমার নামে এক গ্রামের কার্বারীকে দিনে দুপুরে বল্লম দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে চাষযোগ্য জমিতে পুতে রাখা হয়। যে গ্রামে হত্যাকান্ড ঘটে সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে ১৯০ নং বান্দরছড়া মৌজার হেডম্যানকে ঈশ্বর যীশুর মতো দু’হাত এবং দু পায়ে পেড়েক মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। গদ্দাধর ত্রিপুরা। তিনি একজন কার্বারী। দুই ছেলেসহ তাকে বেঁধে রাখা হয়। তাদের বাবাকে যখন জবাই করছিল সেটেলার বাঙালীরা তখন বড় ছেলে কুসুম জালা ত্রিপুরা (পরে যিনি তাঁর বাবার পর কার্বারী হন) বাঁধা অবস্থায় লাফ দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। ছোট ছেলে কিরন চন্দ্র ত্রিপুরা আর বাবা গদ্দাধর ত্রিপুরাকে মেরে ফেলা হয়। তখন চলছিল বর্ষার মৌসুম এবং সারা রাত বৃষ্টি ছিল। পুরো গ্রাম যখন জ্বলছিল তখন পুরো আকাশ লাল দেখা যাচ্ছিল। ফেনী নদীতে প্রচুর পানি বেড়ে যায়। বহু কষ্টে সবাই ভেজা কাপড় নিয়ে চেল্লাছড়া পাড়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরায় চলে গিয়েছে।
অন্যদিকে আরও ১০/১৫ টি গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষ একজন ওসির সুরক্ষা বলয়ে ছিল। খবর পেয়ে দা, বল্লম নিয়ে হত্যা করার জন্য সেটেলার বাঙালীরা ছুটে আসলে ওসি তাদের থামিয়ে দেন এবং বলেন যা হবার হয়েছে এখন আর কোন কিছু করা যাবে না। সেটেলাররা ওসির সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। পরে শুনা যায় জুম্মদের বাঁচানোর অপরাধে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর ১৩টি অধিক গণহত্যা চালানো হয়েছে, বহুবার সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে, জুম্ম নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে কিন্তু একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার পায়নি জুম্ম জনগণ।