সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি
আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত, সাবেক সাংসদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি, মেহনতি জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৮৩তম জন্ম দিবস। ১৯৩৯ সালের আজকের এই দিনে রাঙ্গামাটির নানিয়াচরের বুড়িঘাট মৌজার মহাপ্রুম (মাওরুম) গ্রামে চিত্ত কিশোর চাকমা ও পঙ্কজিনী দেওয়ানের ঘর আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ।
মহান নেতার ৮৩তম জন্ম দিবসে খাগড়াছড়ি সদরে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ সকাল ১০ ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি সদরস্থ খাগড়াপুরের জে বি সি রেস্টুরেন্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যাগে এক আলোচনা আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভার শুরুতে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্ধ্বোধন করা হয়। বেলুন উড়িয়ে আলোচনা সভা উদ্ধ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংগ্রামী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শ্রী সুভাষ কান্তি চাকমা। এরপর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৩ তম জন্মদিবস উপলক্ষে কেক কাটা হয়। জন্ম দিবসের কেক কাটেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রাম সহ-সভাপতি শ্রী বিভূ রঞ্জন চাকমা।
আলোচনা সভায় সাবেক ছাত্র নেতা ও জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শ্রী সুমেধ চাকমার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী আরাধ্যপাল খীসা। সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী প্রণব চাকমা, সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী বিভূরঞ্জন চাকমা, সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী অজিত ত্রিপুরা, পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রী সুভাষ কান্তি চাকমা প্রমূখ। এছাড়াও আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্টির উপদেষ্টা কমিটির সংগ্রামী সদস্য শ্রী কমল বিকাশ চাকমা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী সিন্ধু কুমার চাকমা, তিনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার শহীদের ৩৯ বছর হয়ে গেলেও হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় না আনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং একে হত্যাকারীদের প্রশয় দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। তিনি বলেন যদি মামলার বাদী না থাকে তাহলে তিনি নিজেই বাদী হবেন বলেও পার্টির নেতৃবৃন্দের কাছে আহ্বান রাখেন। এছাড়াও আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রী সুজন চাকমা ঝিমিট; পানছড়ি উপজেলার ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের সম্মানিত চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা; জনসংহতি সমিতি মহালছড়ি থানা শাখার সংগ্রামী সভাপতি শ্রী নীলরঞ্জন চাকমা, খাগড়াছড়ি সদর থানা শাখার সংগ্রামী সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমা, দীঘিনালা থানা শাখার সংগ্রামী সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী সমীর চাকমা, বাঘাইছড়ি থানা শাখার সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রী জোসি চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সংগ্রামী সহ-সভাপতি শ্রী প্রীতিখীসা প্রমূখ।
বক্তারা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বিভিন্ন সারগর্ভ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত সকলকে এবং জুম্ম জনগণকে এমএম লারমার প্রদর্শিত মত, পথ ও আদর্শ মেনে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এমএন লারমার প্রদর্শিত প্রগতিশীল মতাদর্শকে জুম্ম জনগণ যদি মনপ্রাণ দিয়ে ধারণ করতে পারে তাহলে জুম্ম জনগণ তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হবেন বলে ব্যক্ত করেন।
বক্তারা আরো বলেন, লারমা ছিলেন একজন প্রকৃত প্রগতিশীল চেতনার ধারকবাহক, এবং মেহনতী মানুষের পরম বন্ধু। যার কারণে তিনি গণ পরিষদ ভাষণে মাঝি-মাল্লা, কৃষক, মেথর, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালাদের কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন। বলেছিলেন “নারীর যে অধিকার এখানে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। নারীকে যদি অধিকার দিতে হয় তাহলে পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে নারীকেও সে অধিকার দিতে হবে।” সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির যে আন্দোলন তা নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব বলেও বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।

অতিথি বক্তব্যে শ্রী প্রণব চাকমা বলেন, যে রণনীতি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের সূচনা হয়েছে সে রণনীতি থেকে জুম্ম জনগণ আজও একচুলও নড়তে পারেনি। তিনি মাও সেতুং এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্দোলনের প্রথম শর্ত হচ্ছে শত্রু কে আর মিত্র কে তা নির্ধারণ করা। কিন্তু আমরা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার কারণে ১০ নভেম্বর ‘৮৩ সালে মহান নেতা এমএন লারমাসহ ৮ জুম্ম বীর যোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছি। এর পরবর্তী গৃহযুদ্ধ এবং চুক্তি পরবর্তী ইউপিডিএফের আবির্ভাব এবং পর্যায়ক্রমে জেএসএস ও ইউপিডিফের বিভিক্তি এবং একে অপরের মধ্যে সংঘাতই প্রমাণ করে যে আমরা বিপ্লবের প্রথম শর্ত শত্রু কে মিত্র কে নির্ধারণ করতে পারিনি। তিনি আগামী দিনে জুম্ম জনগণের ভয়ংকর পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন ২০২২ সালের এই আদমশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের চাইতে অজুম্মদের সংখ্যা ২ হাজারের অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাঙ্গামাটি ব্যতীত বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে অজুম্মরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। যা আমাদের জুম্মদের জন্য অত্যন্ত বেদনার এবং তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন আগামী ২০৫২ সালে আমরা এখানে একেবারে ১০% এ নেমে আসতে পারি। তিনি বলেন পাকিস্তান আমল হতে বাংলাদেশ আমলের বর্তমান পর্যন্ত অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার যা নীল নকশা তা এখনো জীবন্ত এবং চলমান রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য এবং জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সকল স্তরের নেতৃবৃন্দসহ সমাজের সকল জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজকে শীঘ্রই কিছু পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। অন্যথায় মহাবিশ্বের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে হবে বলেও তিনি ব্যক্ত করেন।
অতিথি বক্তব্যে শ্রী সুভাষ কান্তি চাকমা বলেন, ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে গভীর নিদ্রা থেকে যিনি জাগিয়ে তুলেছেন সেই এমএনলারমাকেই আমরা হত্যা করেছি এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের কিছু নেই। আমরা যেখানেই আন্দোলনের সংগ্রামের সফলতা দেখেছি সেখানেই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম দেখেছি। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ব্যতীত আমরা এমএন লারমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারবোনা বলে তিনি বলেন। তিনি আরো বলেন এমএন লারমা বন্য জীবজন্তু সংরক্ষণ, রিজার্ভ ফরেস্ট সংরক্ষণে পার্টির সকল স্তরের কর্মী বাহিনীকে নির্দেশ দিতেন। তিনি এমন ধর্মপ্রাণ ছিলেন যে তিনি যেখানে গোসল করতেন সে স্থানে (নদী-ছড়া) চিংড়ি, মাছ, কাঁকড়া এসে জড়ো হতো বলেও শোনা যায়। তিনি কর্মী বাহিনীকে সাপ মারতে পর্যন্ত নিষেধ করতেন। তার এমন ধর্মপ্রাণ দেখে জুম্ম জনগণের ইতিহাসে আরেক সংগ্রামী কালজয়ী বীর সৈনিক ক্যা-হ্লাউ ভান্তে মন্তব্য করেছিলেন “আমার মত রং বস্ত্র ধারীদের থেকেও তিনি ধর্ম পালন করেন এবং তার মত ধর্মপ্রাণ মানুষ তৎকালীন ভিক্ষু সমাজে আছেন কিনা সন্দেহ আছে”। তিনি শুধু নিজ ধর্ম নন বিভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থও সাথে রাখতেন বলে জানা যায়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় ঐক্য ব্যতিত বিকল্প কোন পথ নেই বলে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সবশেষে আজকের আলোচনা সভার সভাপতি ও জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী আরাধ্যপাল খীসার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।