খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাঃ নিহত ৪, আহত ৭০

খাগড়াছড়িপার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

আগামীকাল থেকে টানা ৭২ ঘন্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক।

বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি ভ্যানগার্ড

খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় একটি মোটরসাইকেল চোর গনপিটুনিতে নিহতের ঘটনায় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও পরে রাঙামাটি সদরে পাহাড়ী ও বাঙালিদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি সদরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উত্তেজিত জনতার উপর গুলি বর্ষণ করেছে। এতে খাগড়াছড়িতে ৩ জন পাহাড়ী নিহত ও ২০ জন আহত এবং রাঙামাটিতে সংঘর্ষে ১ জন পাহাড়ী নিহত ও ৫৩ জনের অধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বাঙালিদের দেওয়া আগুনে দীঘিনালায় পাহাড়িদের ৯০টি আর রাঙামাটিতে ২০টির অধিক দোকানপাত ও দুই জেলায় ১২০টি অধিক যানবাহন পুড়ে যায়। এ নিয়ে দুই জেলা জুড়ে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।

পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি সদরে আজ সকাল ১০টার সময়ে পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরুপার দিকে যাওয়ার সময় মসজিদের পাশের বিল্ডিং থেকে হঠাৎ করে কে বা কারা মিছিলের উপর ইট ছুড়ে মারে। এতে এক পাহাড়ী ছেলের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। এরপর পাহাড়ীরা উত্তেজিত হয়ে সেদিকে পাল্টা ইট পাটকেল মারতে থাকলে একপর্যায়ে বাঙালীদেরই ছোড়া ইটের আঘাতে মসজিদের জানার কাঁচ ভেঙ্গে যায়। মসজিদে আক্রমণের গুজব ছড়িয়ে শুরু হয় পাহাড়ী ও বাঙালিদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপ। মসজিদে হামলার গুজব ছড়িয়ে সদরের কাঠালতলী এলাকার ঐতিহ্যবাহী প্যাগোডা মৈত্রী বিহারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালানো হয়।

সংঘর্ষ বনরুপা থেকে বিস্তার ঘটে দক্ষিণ কালিন্দিপুর, বিজন সরনি, উত্তর কালিন্দিপুর ও হাসপাতাল এলাকায় মুহুর্তের মধ্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এভাবে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ চলে প্রায় দুই ঘন্টার কাছাকাছি। সংঘর্ষে ১ জন পাহাড়ী নিহত হয় আর উভয়ে ৫৩ জনের অধিক আহত হয় এবং পাহাড়ী ও বাঙালিদের দোকানপাত, বাড়ি ঘর ভাংচুর করা হয়, প্রায় ৩০টিরও বেশী অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। সংঘর্ষে পাহাড়ীরা পিছু হটলে বাঙালিরা এগিয়ে গিয়ে মহিলা বিষয়ক কার্যালয়, জেএসএস জেলা কার্যালয় ও আঞ্চলিক পরিষদের অফিস ভাঙচুর করে এবং বেশ কয়েকটি সরকারী গাড়ি আর স্থানীয় সাংবাদিক হিমেল চাকমা, প্রথম আলোর প্রতিনিধি সাধন বিকাশ চাকমা ও সমকাল প্রতিনিধি সত্রং চাকমার ব্যবহুত মোটর সাইকেল ও স্থানীয়দের গাড়িসহ কমপক্ষে ১০০টির অধিক জ্বালিয়ে দেয়।

এদিকে আগের দিন বিকাল ৪ টা সময়ে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলা সদরে বাঙালিরা দিঘীনালা কলেজের সাধারণ ছাত্র/ছাত্রীর ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে লারমা স্কয়ার এলাকায় পৌঁছলে বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় পাহাড়ি চাল ব্যবসায়ী নিপুন চাকমা (৫২) কে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। পরে পাহাড়িরা এগিয়ে আসলে উভয়ের মধ্য ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঘন্টা খানিক সংঘর্ষ চলার পর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ঘটনাস্থলে আসলে এক পর্যায়ে পাহাড়িরা লারমা স্কয়ার থেকে পিছু চলে যায়। সে সুযোগে উত্তেজিত বাঙালিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি দিঘীনালা থানা শাখা কার্যালয়সহ পাহাড়িদের বসতবাড়ি, দোকানপাত ও হোটেলে লুটপাত চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা সঠিক ভাবে নিরুপণ করা না গেলেও প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী আনুমানিক ৯০টি দোকান ও ১৭ টি মোটরসাইকেল এবং ৩টির অধিক টমটম বাহন পুড়ে দেয়া হয়। ক্ষয়ক্ষতি দেখে পাহাড়িরা উত্তেজিত হয়ে দ্বিতীয় দফায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করলে নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এ সুযোগে বাঙালিরা আবারো পাহাড়ীদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে গুরুতর আহত হয় উদল বাগান গ্রামের বাসিন্দা ধনঞ্জয় চাকমা (৪৫)। তাকে আহত অবস্থায় জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন।

দিঘীনালার এ খবর জানাজানি হলে সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি সদরে পাহাড়িদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। উত্তেজনার এক পর্যায়ে পাহাড়িরা পানছড়ি রোডের পাশে উপালীপাড়া, নারানখাইয়্যা এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি যাওয়ার পথে গতি রোধ করলে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে জুনান চাকমা (২২), পিতা- রুপায়ন চাকমা, গ্রাম- ধর্মপুর ও রুবেল ত্রিপুরা (২৪), পিতা- গর্জন মনি ত্রিপুরা, গ্রাম- পল্টন পাড়া গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে মারা যায়। এছাড়া ২০ জনের অধিক পাহাড়ী গুলিতে মারাত্মক আহত হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আর ৪ জনকে চট্রগ্রাম মেডিকেলে প্রেরণ করা হয়। বাকিদের স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে চট্রগ্রাম ও ঢাকা শহরে অবস্থানরত পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা রাতেই শাহবাগে মশাল মিশিল করে ঘটনার তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ জানান এবং এ প্রতিবাদ আজ সকাল ১০টা সময়ে চট্রগ্রামের চেরাগী পাহাড় ও ঢাকার রাজু ভাস্কর্যে হাজার হাজার পাহাড়ি শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তারা নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। সমাবেশ শেষে বিক্ষদ্ধ পাহাড়ি শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে ৩ পার্বত্য জেলায় আগামী কাল ভোর ৬ টা থেকে ৭২ ঘন্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ঘোষণা দেন।
দুই দিনে পর পর পাহাড়ি ও বাঙালিদের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি একটি গুজবের শহরে পরিণত হয়। দিনে ও রাতে গুজব বের হয়। এতে প্রশাসন অনাখাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে দুই জেলায় আজ ১৪৪ ধারা জারি করেন। এতে করে সন্দেহ অবিশ্বাস কিছুটা দুর হলেও গুজব এখনো রয়েছে।

এমন অবস্থায় পাহাড়ে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি সরকারি প্রতিনিধি দল আগামী কাল রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি আসছেন। এতে নেতত্ব দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে: জে: জাহাঙ্গীর আলম। আরো থাকছেন পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদুত বাবু সুপ্রদীপ চাকমা, স্থানীয় সরকার ও সমবায়, পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা জনাব এ এফ হাসান আরিফ । তারা আগামী কাল সকালে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে প্রথমে রাঙামাটি আসবেন। সেখানে ১১টায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করবেন। তারপর সেখান থেকে ২টা সময়ে খাগড়াছড়ি হেলি যোগে রওনা করবেন এবং বিকাল ৩ টায় জেলা প্রশাসক সন্মেলন কক্ষে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে পরিবেশ শান্ত রাখার করনীয় সম্পর্কে মিটিং করবেন। এরপর বিকাল ৫ টা সময়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়ি ত্যাগ করবেন।

Tags: , , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীতে ‘মার্চ ফর আইডেন্টিটি’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu