সিএইচটি ভ্যানগার্ড
পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই ও নারী জাগরণের অন্যতম সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন ভোররাতে অপহরণ করা হয় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন কল্পনা চাকমা।
দীর্ঘ ২৮টি বছর পেরিয়ে গেছে কল্পনা চাকমা অপহরণের, কিন্তু রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু অভিযুক্ত তৎকালীন কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের লে. ফেরদৌসসহ তার দৌসরদের বিচারের আওতায় না এনে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ দিয়েছেন। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অপহৃত কল্পনার কোনো হদিস প্রদান ও অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যর্থতা নিয়ে এবং প্রতিবেদনটির উপর বাদীর নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করেই আদালত এই মামলাটি অবসানের আদেশ দেন।
৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে সংঘটিত হওয়া এই অপহরণের ঘটনাটি দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও প্রগতিশীল সংগঠন এর প্রতিবাদ ও বিচারের দাবী জানায়। ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে ঘটনার প্রায় দেড় মাসের পর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন সরকারের নিকট জমা দিলেও তা আজো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
কল্পনা চাকমা অপহরণের সাক্ষী তাঁর দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা। অপহরণকারীরা কল্পনা চাকমার সাথে তাঁদের দুই ভাইকেও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস তারা পথিমধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা স্পষ্টভাবে অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনতে পেরেছিলেন। অপহরণ ঘটনার পরবর্তী সময়ে কালিন্দী কুমার চাকমা লে. ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামি করে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে অভিযুক্তদের নাম বাদ দিয়ে মামলা রুজু করে।
মামলা করার প্রায় সাড়ে চৌদ্দ বছর পর ২১ মে ২০১০ তারিখে বাঘাইছড়ি থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই ফারুক প্রথম চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা এ প্রতিবেদনের ওপর নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ০২/০৯/২০১০ তারিখে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডি’র তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ দুইবছর তদন্ত করে চিহ্নিত অপহরণকারীদের নাম বাদ দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এরপর একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন হতে থাকে কিন্তু চিহ্নিত অপহরণকারীদের বিচার হয়না। কল্পনা চাকমার সন্ধান রাষ্ট্র দিতে পারেনা। দীর্ঘ ২৮ বছরেও কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার না হওয়ায় দেশে বিচারহীনতার চিত্রই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। আর এতেই প্রমাণ হয়, এই অপহরণ ঘটনা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদেই এই ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। সে কারণেই হয়তো অপহরণের দায়মুক্তির জন্য মামলাটি খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।