চট্টগ্রাম ও ঢাকা প্রতিনিধি
“যারা মরতে জানে, পৃথিবীতে তারা অজেয়। যে জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে জানে না, সে জাতির বেঁচে থাকার কোন অধিকার থাকতে পারে না” স্লোগানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম এবং ঢাকাতে ১০ নভেম্বর ২০২৪ ইং প্রস্তুতি কমিটির আহ্বানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য ও ছবির মাধ্যমে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামঃ
জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস ১০ নভেম্বর ২০২৪ইং, রবিবার দুপুর ২.০০ ঘটিকার সময়ে পোর্ট সিটি কমিউনিটি সেন্টার, সল্টগোলা রেল ক্রসিং সংলগ্ন, বন্দর, চট্টগ্রামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সুনয় চাকমার সঞ্চালনায়, ১০ নভেম্বর ২০২৪ইং প্রস্তুতি কমিটি- চট্টগ্রামের আহ্বায়ক জ্ঞান বকুল চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি প্রত্যয় চাকমা। আলোচনা সভায় বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি চট্টগ্রাম মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরচ্ছাফা ভূঁইয়া, বাসদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ইনচার্জ ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি আল কাদেরি জয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুজন চাকমা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি মিরাজ উদ্দিন, আদিবাসী শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি রমেল চাকমা, আদিবাসী শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি নিখিল চাকমা প্রমুখ।
আলোচনা সভায় শুরুতে কালো ব্যাচ ধারণ, অস্থায়ী শহীদ ভেদীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সহ সকল জুম্ম বীর শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
আলোচনাসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি মিরাজ উদ্দিন বক্তব্য বলেন- পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতীত দশ ভিন্ন ভাষাভাষী ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে কিভাবে তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন করেছিলেন সে বিষয়ে আলোচনা করেন। এমএন লারমা তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে জুম্ম জনগণকে শিক্ষায় শিক্ষিত করে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম শিখিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের জন্য, জুম্ম জনগণের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি সংসদের ভেতরে ও বাইরে লড়াই করেছেন। তিনি রিকশাওয়ালা, মেথর, দিন মজুর, মাঝি-মাল্লা, নিষিদ্ধ পল্লীতে নির্যাতিত মহিলাদের কথা, নারীদের অধিকারের কথা, নিপীড়িত মানুষের তিনি সংবিধানে বলেছেন। সে কারণে তিনি শুধু জুম্ম জনগণের নেতা নন, তিনি মেহনতি মানুষের নেতা। সমগ্র বিশ্বের অধিকার হারা মানুষের নেতা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুজন চাকমা বলেন -পৃথিবীর ইতিহাসে যেখানে নিপীড়ন হয়েছে, যে জাতির উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে, যে সমাজের উপর নিপীড়ন করা হয়েছে সেখানেই তরুন-ছাত্র সমাজ দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেই তরুণ এমএন লারমার হাত ধরেই। আগামী দিনের লড়াই সংগ্রামেও পাহাড়ের তরুণ-ছাত্র সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এমএন লারমারা যেভাবে অকুতোভয় সৈনিক হয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তেমনি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা জুম্ম জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী, যারা জুম্ম জনগণের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামে মাধ্যমে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভুলণ্ঠিত করতে চাই তাদের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তরুণ-ছাত্র সমাজের মাঝে এগত্তরের(ঐক্য) ডাক উঠেছে কিন্তু সেই এগত্তরের সূত্রটা কি হতে পারে সেই সূত্রটা বের করতে হবে। আমরা মনে করি সেই এগত্তরের সূত্রটা হচ্ছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ যুগপৎ আন্দোলন। সুতরাং চুক্তিকে নানা ধরণের অপব্যাখ্যা না দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা তেমন কঠিন কিছু নয়। তরুণ প্রজন্মকে এমএন লারমা’র আদর্শ বুকে ধারণ করে এমএন লারমার দেখা স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে মনপ্রাণ দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
বাসদ,চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ইনচার্জ আল কাদেরি জয় বক্তব্য বলেন – এম এন লারমা জুম্ম জাতির জাতীয় উন্মেষ সাধন করেছিলেন, যিনি জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের লক্ষ্যে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের মহান পার্টি জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়েছিল যারা পতাকাতলে ১০টি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এম এন লারমার কর্ম, সাধনা, চিন্তার যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। নিপীড়িত জুম্ম জনগণ এবং ব্যাক্তি এম এন লারমার লড়াইকে একই সূতায় গাঁথা দরকার। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি উত্তর প্রজন্মের জুম্ম জনগণের লড়াইকে এগিয়ে নিতে সঠিকভাবে এম এন লারমাকে উপস্থাপনও এই সময়ের দাবি। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে, প্রত্যেক প্রজন্মকে সামনে এগোনোর জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কর্ম, চিন্তা, দর্শনকে ক্রিটিক্যালি বিচার করতে হয় এবং সঠিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণিত ভুল ঝেড়ে ফেলে যা নতুন প্রজন্মের জন্য সঠিক, সময়োপযোগী তা গ্রহণ করতে হয়। তাঁর প্রদর্শিত পথ ও নির্দেশিত নীতিকৌশল আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায়ের সংগ্রামে একমাত্র দিশারী হয়ে থাকে। মহান নেতার আত্মত্যাগ তিতিক্ষা যুগে যুগে দেশের প্রতিটি মুক্তিকামীর এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণার উৎসস্থল।
বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি চট্টগ্রাম মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরচ্ছাফা ভূঁইয়া বক্তব্য বলেন :
এই মহান নেতা বিপ্লবীর আশা, স্বপ্ন, সাধনা,কর্ম, আমাদের পথ দেখায় নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে। এবং মহান নেতার আশার বাণী শুনে বলি, জয় আমাদের হবেই হবে। নিপীড়িত জনগণের জয় হবেই হবে। এম এন লারমাও নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যকাশে মুক্তির ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন।
আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক প্রত্যয় চাকমা বক্তব্য বলেন – প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ব্যক্তি, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করেন।
বিপ্লবী এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর চলমান উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র মৌলবাদ, ইসলামী সম্প্রসারণবাদ ও সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা – সামন্তীয় সমাজ ব্যবস্থায় গোষ্ঠীবাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দশ ভাষাভাষী ১১টি জাতিকে জুম্মজাতীয়তাবাদের পতাকাতলে একত্রিত করার মাধ্যমে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানোর অগ্রদূত। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চির নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি শুধুমাত্র জুম্ম জনগণের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন না, সোচ্চার ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে মেহনতি মানুষের কথা, শোষণহীন সমাজের বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবী জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাঁর এই দাবী সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়নি, যেকারণে ‘৭১ সালে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণ তা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও পূরণ হয়নি। তাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে গঠিত অর্ন্তবর্তী সরকার যে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেই সংবিধানে এম এন লারমার সেই সময়ের সংসদ বক্তব্য, দাবীগুলোর প্রাধান্য দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ আগষ্ট আওয়ামিলীগ সরকার পতনের পরবর্তীতে পাহাড়েও সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলন নামে যে ফ্লাটফর্ম দাড়িয়েছে তাদের পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসী বিষয়ে যে চিন্তা চেতনা জাগ্রত হয়েছে সেটির সাধুবাদ জানান।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ দুই যুগের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফলস্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ সূত্রীতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান এখনও অধরায় রয়ে গিয়েছে। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে চুক্তি বিরোধী একের পর পর এক ষড়যন্ত্র চলছে, যার মাধ্যমে একটি মহল স্বার্থ হাসিলের হীন চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। পাহাড়ের একটি ক্ষুদ্র অংশও চুক্তি বিরোধীতা করে এই ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে দীর্ঘ ২৭টি বছর ধরে জুম্ম জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে।
আলোচনা সভা থেকে চুক্তি বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলার আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকাঃ
জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবসটি ঢাকার সাভারে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী শহীদদের স্মরণের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে।
মহান নেতা এমএন লারমাসহ সকল শহীদদের স্মরণে সকাল ৮টায় অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পরবর্তীতে দিবসটিকে কেন্দ্র করে সকাল ৯ ঘটিকায় ১০ নভেম্বর ২০২৪ইং প্রস্তুতি কমিটি, সাভার, ঢাকার উদ্যোগে আশুলিয়াতে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদে ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি এল্টন চাকমার সঞ্চালনায় এবং আদিবাসী শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আনন্দ বিকাশ চাকমা সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুদর্শন চাকমা, শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতি বিষয়ক সম্পাদক সোহাগ চাকমা, কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য ও প্রাক্তন ছাত্র নেতা রাজ্যময় চাকমা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মঞ্জু মিত্র চাকমা, রতন বিজয় চাকমা, সুমিত্র চাকমা প্রমুখ।