এমএন লারমা’র ৮৪তম জন্মদিবসে খাগড়াছড়ি সদরে আলোচনা সভা

খাগড়াছড়িপার্বত্য চট্টগ্রাম

সিএইচটি ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি সদর

আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত, সাবেক সাংসদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি, মেহনতি জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৮৪তম জন্ম দিবস। ১৯৩৯ সালের আজকের এই দিনে রাঙ্গামাটির নানিয়াচরের বুড়িঘাট মৌজার মহাপ্রুম (মাওরুম) গ্রামে চিত্ত কিশোর চাকমা ও পঙ্কজিনী দেওয়ানের ঘর আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ।

মহান নেতার ৮৪তম জন্ম দিবসে খাগড়াছড়ি সদরে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ সকাল ১০ ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি সদরস্থ খাগড়াপুরের জে বি সি রেস্টুরেন্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির উদ্যাগে এক আলোচনা আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভার শুরুতে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্ধ্বোধন করা হয়। বেলুন উড়িয়ে আলোচনা সভা উদ্ধ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংগ্রামী কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী সুধাকর ত্রিপুরা মহোদয়।

আলোচনা সভায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রী সাধারণ সম্পাদক শ্রী সোহেল চাকমার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমা। সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী অংশুমান চাকমা, সংগ্রামী তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্রী বিভূরঞ্জন চাকমা, জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সভাপতি শ্রী আরাধ্যপাল খীসা প্রমূখ, মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রীমতি ববিতা চাকমা, উপজাতীয় ঠিকাদারি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শ্রী রবিশংকর তালুকদার। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন সাবেক ছাত্র নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য শ্রী রাজ্যময় চাকমা। এছাড়াও আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রী সুজন চাকমা ঝিমিট; যুব সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমাসহ পার্টির নেতৃবৃন্দরা।

বক্তারা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বিভিন্ন সারগর্ভ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত সকলকে এবং জুম্ম জনগণকে এমএম লারমার প্রদর্শিত মত, পথ ও আদর্শ মেনে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এমএন লারমার প্রদর্শিত প্রগতিশীল মতাদর্শকে জুম্ম জনগণ যদি মনপ্রাণ দিয়ে ধারণ করতে পারে তাহলে জুম্ম জনগণ তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হবেন বলে ব্যক্ত করেন।

বক্তারা আরো বলেন, লারমা ছিলেন একজন প্রকৃত প্রগতিশীল চেতনার ধারকবাহক, এবং মেহনতী মানুষের পরম বন্ধু। যার কারণে তিনি গণ পরিষদ ভাষণে মাঝি-মাল্লা, কৃষক, মেথর, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালাদের কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন। বলেছিলেন “নারীর যে অধিকার এখানে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। নারীকে যদি অধিকার দিতে হয় তাহলে পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে নারীকেও সে অধিকার দিতে হবে।” সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির যে আন্দোলন তা নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব বলেও বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।

অতিথি বক্তব্যে শ্রী সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সেই এমএন লারমা জুম্ম জনগণের অধিকার সম্পর্কে চিন্তা করতে পেরেছেন। তিনি যে কতটা প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী চিন্তার অধিকার ছিলেন তার বর্ণাঢ্য জীবন অধ্যয়নেই বুঝতে পারি। তিনি বলেন, ১৯৩৯ থেকে ১৯৮৩ মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তা আমরা চিন্তা করা কুলিয়ে উঠতে পারিনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০ ভিন্ন ভাষাভাষি ১১টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা যে একই সুত্রে গাঁথা তা একমাত্র তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছেন এবং শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জুম্ম জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের জন্য একত্রিত করতে পেরেছিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের উপর দেয়া একটি বক্তব্য তুলে ধরেন ”

আমি দেখতে পাচ্ছি, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গাঁ, শঙ্খ, মাতামহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসের পর বৎসর ধরে নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই মনের কথা এ সংবিধানে লেখা হয়নি। আমি বলছি আজকে যাঁরা রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন, তাদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি। আজকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আপনারা বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের কথা সমাজতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের নামে বলে চলেছেন।আমি ক্ষুদ্র মানুষ সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার সেরকম নাই। তবু আমার বিবেক বলছে এই সংবিধানের কোথায় যেন গলদ রয়েছে। মাননীয় স্পীকার সাহেব সাহেব, আজকে যারা কল-খানায় চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাঁদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ প্রতিটি জিনিষ তৈরী হচ্ছে, সে লক্ষ লক্ষ মেহনতী মানুষের মনের কথা এখানে নাই।

এই বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, এমএন লারমা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের কথা বলেননি তিনি সকল মেহনতী মানুষের কথা বলেছেন তাই তিনি সমগ্র বিশ্বে অধিকার হারা মানুষের অধিকার আদায়ের একজন অগ্রসেনানি এবং মহানায়ক।

অতিথি বক্তব্যে শ্রী অংশুমান চাকমা বলেন, যে রণনীতি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের সূচনা হয়েছে সে রণনীতি থেকে জুম্ম জনগণ আজও একচুলও নড়তে পারেনি। তিনি মাও সেতুং এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্দোলনের প্রথম শর্ত হচ্ছে শত্রু কে আর মিত্র কে তা নির্ধারণ করা। কিন্তু আমরা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার কারণে ১০ নভেম্বর ‘৮৩ সালে মহান নেতা এমএন লারমাসহ ৮ জুম্ম বীর যোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছি। এর পরবর্তী গৃহযুদ্ধ এবং চুক্তি পরবর্তী ইউপিডিএফের আবির্ভাব এবং পর্যায়ক্রমে জেএসএস ও ইউপিডিফের বিভিক্তি এবং একে অপরের মধ্যে সংঘাতই প্রমাণ করে যে আমরা বিপ্লবের প্রথম শর্ত শত্রু কে মিত্র কে নির্ধারণ করতে পারিনি। তিনি আগামী দিনে জুম্ম জনগণের ভয়ংকর পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন ২০২২ সালের এই আদমশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের চাইতে অজুম্মদের সংখ্যা ২ হাজারের অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাঙ্গামাটি ব্যতীত বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে অজুম্মরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। যা আমাদের জুম্মদের জন্য অত্যন্ত বেদনার এবং তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন আগামী ২০৫২ সালে আমরা এখানে একেবারে ১০% এ নেমে আসতে পারি। তিনি বলেন পাকিস্তান আমল হতে বাংলাদেশ আমলের বর্তমান পর্যন্ত অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার যা নীল নকশা তা এখনো জীবন্ত এবং চলমান রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য এবং জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সকল স্তরের নেতৃবৃন্দসহ সমাজের সকল জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজকে শীঘ্রই কিছু পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। অন্যথায় মহাবিশ্বের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে হবে বলেও তিনি ব্যক্ত করেন।

সবশেষে আজকের আলোচনা সভার সভাপতি ও জনসংহতি সমিতি খাগড়াছড়ি সদর থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি শ্রী প্রত্যয় চাকমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

পানছড়িতে এমএন লারমা’র ৮৪তম জন্মদিবসে আলোচনা সভা
সাজেকে নিউমোনিয়ায় আরো এক শিশুর মৃত্যু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu