সিএইচটি ভ্যানগার্ড
আজ ১০ নভেম্বর ২০২২ খ্রি., জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, প্রগতিশীল চিন্তারধারার ধারকবাহক, সাবেক সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ আট সহযোদ্ধার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন ও জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে বেদনাবিধূর ও শোকাবহ একটি দিন ১০ নভেম্বর।
বিভেদপন্থী, জাতীয় বেঈমান, চরম বিশ্বাসঘাতক, পার্টির ভিন্নমতাবলম্বী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র ও দেশী-বিদেশী গভীর ষড়যন্ত্রে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ আট সহযোদ্ধাকে। সেই আক্রমণে শহীদ হন এম.এন. লারমা’র বড় ভাইশুভেন্দু প্রভাস লারমা (তুফান), মেজর পরিমল বিকাশ চাকমা (রিপন), কর্পোরেল অর্জুন ত্রিপুরা (অর্জুন), গ্রাম পঞ্চায়েত বিভাগের সহকারী পরিচালক অর্পনা চরণ চাকমা (সৈকত), সেঃ লেঃ অমর কান্তি চাকমা (মিশুক), গ্রাম পঞ্চায়েত বিভাগের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক কল্যাণময় খীসা (ডাঃ জুনি), সেঃ লেঃ মনিময় দেওয়ান (স্বাগত) এবং আহত অবস্থায় দুইদিন জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে থেকে অত্যাধিক রক্তক্ষরণে শাহাদাৎ বরণ করেন কর্পোরেল সন্তোষময় চাকমা (সৌমিত্র)। এই আক্রমণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন মুক্ত বিকাশ চাকমা ও মংসাজাই মারমা (জাপান)।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৩৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের মহাপুরম (মাওরুম) গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পিতার নাম চিত্ত কিশোর চাকমা ও মাতার নাম সুভাষিণী দেওয়ান। সবার বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু), বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাস লারমা (বুলু), ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু)। এমএন লারমা’র সহধমীনির নাম পঙ্কজিনী চাকমা। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলের নাম জয়েস লারমা ও মেয়ে পারমিতা লারমা।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার জন্মস্থান মহাপুরম জুনিয়র হাইস্কুলে। তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ এবং ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বি.এ ও ১৯৬৮ সালে বি.এড ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি এল.এল.বি ডিগ্রীও অর্জন করেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাহাড়ী ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন, এরপর পাহাড়ী ছাত্র সমাজকে আন্দোলনে সংগঠিত করতে শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে যোগ দেন পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়নে। ১৯৬০ সালের দিকে পাহাড়ী মানুষদের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে সাথে নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তুলেন। কাপ্তাই বাঁধের ভয়াবহতার কথা লিফলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে সচেতন ও প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তান সরকার কাছে তিনিি আটক হন। দুই বছরের অধিক সময় পর লারমা ১৯৬৫ সালের ৮ই মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রæয়ারী এমএন লারমা’র নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ও প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারী সন্ধ্যা ৬টা নাগাধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৪দফা দাবীনামা পেশ করে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানে এদেশের মূল জাতিগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধীতা করেছিলেন। লারমা’র দাবী তখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়: ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
এর প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেছিলেন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এমএন লারমা। এর আগে খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়, তাতে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে । কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন করার প্রাক্কালে লারমা উগ্র আধিপত্যবাদী বাঙালী জাতীয়তবাদের তীব্র বিরোধীতা করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শাসন ব্যবস্থাসহ জুম্ম জণগণের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দাবী করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রীয় শক্তি লারমা’র ন্যায্য দাবিকে প্রত্যাখান করেছিল সেদিন। জুম্ম জনগণের পাশাপাশি দেশের কৃষক, তাঁতি, জেলে, মাঝি-মাল্লা, কলকারখানার শ্রমিকসহ সকল মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লারমা গণপরিষদে জোর দাবী রেখেছিলেন। সংবিধানে সকল ধর্ম ও নারীর সমমর্যাদা রক্ষার জন্য লারমা বারংবার আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়নের সময় লারমা ছিলেন নিসঙ্গ অভিযাত্রী। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিলো অমিত তেজ। গণপরিষদে বার-বার তাঁর মাইক বন্ধ করা হলেও ফ্লোর পেলেই তিনি জুম্ম জনগণের কথা, নারী অধিকার এবং মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলতেন। লারমা সাম্যবাদী দর্শনের সৈনিক ছিলেন ছাত্র জীবন থেকেই। মার্কসীয় সমাজ বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করে শ্রমজীবি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা থেকে তিনি সংবিধান প্রণয়নের সময় শ্রমিক, মেহনতি জনতা ও নিপীড়িত জাতিসমূহের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভ‚মিকা রেখেছিলেন।
লারমা ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন ইংল্যান্ডে। তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগদান করেছিলেন।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অধিকার আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ১৯৭৩ সালের ০৭ জানুয়ারী গোপনে গড়ে তোলা হয় সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংগঠিত হলে লারমা পরের দিনই আত্মগোপনে চলে যান। একই সাথে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মহিলা সমিতি, জুমিয়া সমিতি, যুব সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী। মার্ক্সীয় আদর্শ তিনি ধারণ করেছিলেন তার আন্দোলনের জন্য। পরে জিয়াউর রহমান সমতল থেকে নদী ভাঙা অঞ্চলের বাঙালীদের পাহাড়ী অঞ্চলে অভিবাসিত করলে সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই তীব্রতর হয়।
একসময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম শিক্ষিত সমাজকে গ্রামে চলো স্লোগানে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং জুম্ম শিক্ষিত সমাজ পাহাড়ে ফিরে এসে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতার পেশায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জুম্ম সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় অধিকাংশ কর্মীই ছিলেন শিক্ষক, যার কারণে এই আন্দোলনের নাম টিসার্চ রিভ্যুলেশন নামেও সমধিক পরিচিত। এদেশের সেনাবাহিনীরাও নাম দিয়েছিলেন টিসার্চ রিভ্যুলেশন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজেও ১৯৬৬ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ও প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি, যে সংগঠন এমএন লারমা’র নিজ হাতে গড়া। ঘুমন্ত জুম্ম সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন অধিকার আদায়ের জন্যে। আন্দোলন-সংগ্রাম শিখিয়েছেন জুম্ম জনগণকে। মেহনতী মানুষের কথা বলেছেন সবসময়। তাইতো আজো পাহাড়ে পাহাড়ে এমএন লারমার জয়গাথা উচ্চারিত হয়। কাপ্তাই বাধেঁর কারণে যেদিন উদ্বাস্তু হয়ে চলে যাচ্ছিলেন নিজ ভিটেমাটি থেকে নিয়েছিলেন এক মুঠো মাটি, কি প্রতিজ্ঞা ছিলো আমরা জানিনা, তবে এটুকু আমরা বলতে পারি যে জন্মভ‚মিকে মুক্ত করাই ছিল তার লক্ষ্য ।
১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮২ সালেও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। জনসংহতি সমিতিতে সৃষ্টি হয় অন্তর্দ্বন্ধ। এমএন লারমার নেতৃত্বে লাম্বা গ্রুপ ও প্রীতি কুমার চাকমা’র নেতৃত্বে বাদি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। দলীয় ঐক্যকে সংহত করার লক্ষ্যে লারমা ভিন্নমতাবলম্বীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সেদিকে পা বাড়াননি । ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সালের ভোর রাতে তারা লারমা’র গোপন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। লারমাকে রক্ষার জন্য লারমা’র সহযোদ্ধারা মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান। জুম্ম জনগণের মহান নেতাকে রক্ষার সকল প্রতিরোধ অতিক্রম করে ঘাতকরা লারমা’র কাছে পৌঁছে যায়। ঘাতকের নির্মম বুলেট নিপীড়িত জনতার মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনানী লারমার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। ১০ নভেম্বর ১৯৮৩, বাদি চক্রদের বুলেটে নিভে যায় লারমার জীবন প্রদীপ। সাথে শহীদ হন লারমা’র ৮ সহযোদ্ধা।
ঘাতকের বুলেট লারমা’র জীবন কেড়ে নিয়েছে সত্য। তবে লারমা’র আত্মত্যাগ, তাঁর জীবন দর্শন প্রতিনিয়ত নিপীড়িত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। নির্লোভ ও নির্মোহ জীবনযাপনে লারমা চিরকাল অনুকরণীয়। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রকার ভোগবাদ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সব সময় আপোষহীন। সাচ্চা, ত্যাগী বিপ্লবী এ-নেতার জীবন, তাই মরণেই থেমে থাকে না। ঘাতকেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হয়েছে বহু আগে। কিন্তু লারমা চির দীপ্যমান।
দিবসটি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এছাড়াও খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়াস্থ সূর্যশিখা ক্লাব প্রাঙ্গনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে দিবসী যথাযথভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।