আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসী

মতামত

ভ্যানগার্ড ডেস্ক

ফাইল ছবি

রক্তিম চাকমা

আদিবাসী দিবস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে আদিবাসী কাদের বলা হবে সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। আদিবাসী কাদের বলা হবে সে বিষয়ে জাতিসংঘ, ইউনেস্কোসহ কোন সংস্থাই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেনি। সেজন্য আদিবাসী বিষয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী বিতর্ক প্রচুর। তারপরও আমরা আদিবাসী কাদের বলা হবে সে বিষয়ে কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারি। “সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী”।

জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী’র সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, “Indigenous people are such population groups as we are, who from old age times have inhabited the lands when we live, who are awere of having a characters of our own, with social tradition and means of expression that are linked to the country inhabited from our ancesters, with a language or our own and having certain essential and unique characteristics which confer upon us the strong conviction of belonging to a people,who have an identity in ourselves and should be thus regarded by others (1993)”

আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলনে আদিবাসী চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে, “Peoples in independent countries who are regarded as indigenous on occount of their decent from the populations which inhabited the country or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonisation or the establishment of present state boundaries and who irrespective of their legal status,retain some or all of their social, cultural and political institutions(1989).”

অর্থাৎ “আদিবাসী বা দেশজ মানবসমাজ, জনগোষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজ বাসভূমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা তাদের বাসভূমিতে অথবা কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকূল থেকে নিজেকে একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন। যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালি না হয়েও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।“

এ সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশের বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির অধিকার রাখে। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, বাঙালি জাতি একটি শংকর জাতি। এ অঞ্চলের আদিম মানবগোষ্ঠী হচ্ছে কোল, সাওতাল, ওঁরাও ও মুন্ডারা। অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড এবং “আর্য” নামক মিশ্রিত মানবসংখ্যাকে নিয়েই বর্তমান বাঙালি জাতি গঠিত। পন্ডিতগণের মতে বাঙালি জাতির মধ্যে “আর্য” রক্তের পরিমাণ শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ। বাকি সমস্তই “অনার্য” রক্ত। কোন সুদূর অতীতে কোল-সাঁওতাল-মুন্ডা-ওরাওঁদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ অস্ট্রালয়েড মানবশাখা, কোচ প্রভৃতি মঙ্গোলয়েড মানবশাখা, “দ্রাবিড়” বলে কথিত মিশ্রিত মানবগোষ্ঠী বাংলাদেশে বন-জঙ্গল সাফ করে বস্তি স্থাপন করেছিল। পরে আর্য বলে কথিত মানুষেরা এসে বাংলাদেশে বসবাস করতে থাকে তাঁর পর কালক্রমে এই জনসমষ্টি পরস্পরের সাথে মিশে গিয়ে এবং সমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছে। অবশ্য উপরোক্ত বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সাঁওতাল, নাগা, মিজো, রিয়াং, ত্রিপুরা প্রভৃতি কয়েকটি শাখা কোন বিশেষ ঐতিহাসিক কারণবশত সমতলভূমি হতে দূরে পাহাড়-পর্বত বা উচ্চ তরাই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে কৃষি-জীবিকার মাধ্যমে নিজ নিজ পৃথক বংশগত বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে আসছে। কেবলমাত্র কৃষি বিভিন্ন মানবশাখার ঐক্য সাধনে অক্ষম। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই শোষণ কার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটাতে পারে এবং তাদের একজাতিরুপে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের প্রধান স্রোত কেবল সমতলভূমির অঞ্চলের উপর প্রবাহিত হওয়ায় এই ব্যবস্থার চাপে বিভিন্ন মানব শাখার মিশ্রণ প্রধাণত সমতল ভূমিতেই ঘটেছে। এই মিশ্রণের ফলেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী জাতির উদ্ভব হয়েছিল। এখানেই প্রতীয়মান হয় যে, বাঙালি জাতির উদ্ভবের পূর্বে এ অঞ্চলে কারা বসবাস করত।

এবার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৪টি ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা করা যাক। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষেরা আরাকান, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসার পরও তারা কেন আদিবাসী? একসময় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার নামে কোন রাষ্ট্র ছিলনা, সমগ্র ভূখন্ডকেই ভারতবর্ষ বলে আখ্যায়িত করা হতো। বৃটিশরা চলে যাবার পরই এসব রাষ্ট্রগুলোর উদ্ভব হয়েছে। কাজেই এরা ভারত থেকে এসেছে, মায়ানমার থেকে এসেছে তাই তারা আদিবাসী না এসব যুক্তি নিতান্তই হাস্যকর। অন্যদিকে বৃটিশ শাসনের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন একটি রাজ্য। বৃটিশরা আসার পরেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বৃটিশ কলোনিতে অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে পরাধীন করা হয়। বৃটিশ শাসনের কয়েকশত বছরের পূর্বে হতেই এখানে ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষেরা বসবাস করে আসছিল। দেশ ভাগের সময়ও এ অঞ্চলে ৯৮% মানুষই ছিল অমুসলিম।

জাতিসংঘ ও আইএলও বলছে “আদিবাসী বা দেশজ মানবসমাজ, জনগোষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজ বাসভূমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা তাদের বাসভূমিতে অথবা কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকূল থেকে নিজেকে একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন। যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালি না হয়েও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।“ সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৩০ লক্ষাধিক ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে।

জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০টি দেশে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ৯ আগস্ট আর্ন্তজাতিক দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হলেও বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে পালিত হয়ে আসছে। মূলত, ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হবার পরে বেসরকারীভাবে বৃহৎকারে আর্ন্তজাতিক দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০০ ও ২০০৯ সালে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসী দিবসে দেশের সকল আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দল আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছিল। ২০০৯ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপুমনি সন্তু লারমা-সঞ্জীব দ্রং দের সাথে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে আদিবাসী দিবসের র‍্যালীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১০ সালে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ আদিবাসী দিবসে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন।

২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আদিবাসী দিবসে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ২০০৬ সালের ১৯ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠির মাধ্যমে আদিবাসী শব্দটির পরিবর্তে উপজাতি শব্দটি লেখার নির্দেশ দেয়া হয়। ২০০৮ সালের ১৯ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে আদিবাসী বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একই বছর ৯ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, দেশে কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে। কোনো আদিবাসী (ইনডিজেনাস পিপলস) নেই। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যেখানে অফিস-আদালতে আদিবাসী শব্দটি বাদ দিয়ে উপজাতি ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়।

২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র ( United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples) গৃহীত হয়, সেখানে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৩টি দেশ ভোট দিলেও, বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং ৩৪টি দেশ ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থাকে। ৪টি দেশ যথা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এর মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী কোন অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীই ঐ অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী (Indigenous Population)। সকল ক্ষেত্রেই এই জনগোষ্ঠীকে দেশের মূল জনগোষ্ঠী হতে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে। এছাড়াও আত্মপরিচয় নিরুপনের ক্ষেত্রে তারা ভিন্নতর বলে বিবেচিত হবে এবং নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক মানদন্ডে তাদেরকে বিবেচনা করতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারের কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানার পাশাপাশি, তাদের জীবন ধারণ ও অন্যান্য কাজকর্মের জন্যে ব্যবহৃত জমির উপর তাদের অধিকার থাকবে। এই জমির মধ্যে কোন সরকারী জমি বা খাস জমি থাকবে না। এই জনগোষ্ঠীর বাইরের কেউ এই জমির মালিক হতে পারবে না। এই জমির উপর তাদের অধিকার ও দখল রাষ্ট্র কতৃক নিশ্চিত করা হবে। এমনকি, রাষ্ট্র কতৃক প্রাকৃতিক সম্পদ আহরনের প্রয়োজনে, তাদের মতামত প্রাধান্য পাবে। অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ আদিবাসীদের দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী জেলে পোরার পরিবর্তে, নিজ নিজ গোষ্ঠীর প্রচলিত ধারায় শাস্তি প্রদানকে প্রাধান্য দিতে হবে।২০০৭ সালের জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের মূলে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত জনগোষ্ঠীর বিশেষ কিছু অধিকার থাকবে। যেমনঃ

ক। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (অধ্যায় ৩)।

খ। স্বায়ত্তশাসনের অধিকার (অধ্যায় ৪)।

গ। নিজস্ব ভুমি ও অঞ্চলের উপর অধিকার (অধ্যায় ১০)।

ঘ। নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবংনিয়ন্ত্রনের অধিকার (অধ্যায় ১৪)।

ঙ। সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর যৌক্তিক স্বার্থ রক্ষা কিংবা তাদের অনুরোধ ছাড়া অথবা তারা রাজী না থাকলে রাষ্ট্র কতৃক ঐ অঞ্চলে কোন ধরণের সামরিক কার্যক্রম গ্রহন করতে পারবে না (অধ্যায় ৩০)।

চ। এই ঘোষণাপত্রের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। এমনকি, এই উদ্দেশ্যে জনমত গঠন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বা কারিগরি সহযোগিতার ফোরাম গঠন করতে পারবে ( through the mobilization, inter aila, of financial cooperation and technical assistance) (অধ্যায় ৪১)।

বাংলাদেশ সরকার যদি দেশকে একটি বৈচিত্রময় দেশ ও ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতো তাহলে জাতিসংঘ ঘোষিত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতো। বাংলাদেশ সরকার তা না করে উল্টো ২০১১সালের ৩০শে জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশের ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে জাতি হিসেবে বাঙালি ও বাংলাদেশে কোন আদিবাসীর অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের সংবিধানের নাগরিকত্ব আইনের ৬ নং ধারার ২ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।“ জাতীয়তাবাদ আইনের ৯ এ উল্লেখ আছে যে, “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।“ যেখানে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। সংবিধানের ২৩ (ক) এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। “এখানেও বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীদের যারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে তাদেরকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে রাষ্ট্র আখ্যায়িত করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হোটেল-রিসোর্ট, ইকো পার্ক, পর্যটনসহ বিভিন্ন উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। উগ্র ইসলামি সম্প্রসারণবাদের মাধ্যমে আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করে জাতিগতভাবে নিমূলীকরণ করা হচ্ছে। লাভ জিহাদের ফাঁদে ফেলে আদিবাসী নারীদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। আদিবাসী নারীদের উপর যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের মত ঘটনা প্রতিনিয়ত সংঘটিত করা হচ্ছে। বিহার-মন্দিরে হামলা, আদিবাসী গ্রামে হামলা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে আদিবাসীরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হচ্ছে।

দেশ স্বাধীনের পর জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূল নীতির উপর ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে নির্বাচিত তৎকালীন নির্বাচিত গণ পরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রশ্ন করেছিলেন, “এই চার মূল নীতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ ও সমতলের বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর অবস্থান কোথায় হবে।“ সে সময়ও আদিবাসীদের কথা, নারীদের কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শাসন ব্যবস্থার কথা, কৃষক, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, মেথর, কুলিদের কথা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যার কারণে সেদিন তিনি প্রতিবাদস্বরুপ সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন। গণতান্ত্রিক পন্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের গণ মানুষকে সাথে নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পথে পা বাড়ান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির’র মধ্যে সম্পাদিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি। যা আজ ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো আজো অবাস্তবায়িত। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে দিন দিন অস্থিতিশীল করে তুলছে। ভূমি আদিবাসীদের প্রাণ, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে বলেই তাদেরকে প্রকৃতির সন্তান বলতেও অসুবিধা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যা। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যে সমতল থেকে ৪-৫ লাখ ছিন্নমূল বাঙালিকে পাহাড়ে এনে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ও আদিবাসীদের ভূমিতে তাদের বসতি গড়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে।

এবারের জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় “Leaving No One Behind: Indigenous peoples and the call for a new social contract.” বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক নির্ধারিত বাংলায় প্রতিপাদ্য : “কাউকে পেছনে ফেলে নয় : আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান।

“ আদিবাসীরা দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে সমানতালে এগিয়ে যেতে চায়। তাদের রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিয়ে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

দাবীসমূহঃ

১। আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।

২। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।

৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করে এ অঞ্চলের ভূমি সমস্যাকে প্রথমে সমাধান করতে হবে।

৪। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

৫। বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ঠিকিয়ে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।

৬। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে।

৭। আদিবাসীদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

৮। আদিবাসীদের তাদের মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

Tags: , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

রাজস্থলীতে সেনাবাহিনী কর্তৃক জেএসএস(সন্তু) দলের এক তথ্যদাতা আটক
মাটিরাঙ্গায় ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতেই সবিতা ত্রিপুরাকে হত্যা করা হয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu