আজ নৃশংস নানিয়াচর গণহত্যার ২৭ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রাম

ভেনগার্ড ডেস্ক

ফাইল ছবি

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়াচর একটি উপজেলা। উপজেলা সদরেই নানিয়াচর বাজারটি গড়ে উঠে। ১৯৯৩ সালে ২রা নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের বিষাদময় ইতিহাসে নানিয়াচর গণহত্যার ঘটনা এই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর এক নতুন সংযোজন বলা চলে। রাঙ্গামাটি থেকে ২০ মাইল উত্তরে হ্রদ বেষ্টিত নানিয়াচরের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে পানির পথে নৌযান। লঞ্চঘাটের একমাত্র যাত্রীছাউনিতে দীর্ঘদিন ধরে ৪০ ইবিআর, রাষ্ট্রীয়বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ যাত্রীদের নিয়মিত তল্লাশি নামে হয়রানি-নির্যাতন চালানো হতো। এখানে কর্তব্যরত রাষ্ট্রীয়বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ি বৌদ্ধ নারীদের উত্যক্ত করতো দীর্ঘ দিন ধরে। ২৭শে অক্টোবর খাগড়াছড়ি গামী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দকে আটকে রেখে হয়রানি, নির্যাতন চালানো ও নেতৃবৃন্দকে খাগড়াাছড়ি পায়ে হেটে যেতে বাধ্য করা হয়। তাই পাহাড়ি বৌদ্ধ ছাত্র সমাজ হয়রানি আটকের প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবীতে সোচ্ছার হয় এবং বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্নভাবে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ১৭ নভেম্বর সংঘটিত এই বর্বর গণহত্যায় ২৯ জন জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ, আহত হয় শতাধিক।

ঘটনার সূত্রপাত : নির্ভযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, ২রা নভেম্বর ১৯৯৩ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ যাত্রী ছাউনি থেকে রাষ্ট্রীয়বাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহারের সময় বেঁধে দেয় ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। দিনটি ছিল বুধবার, নানিয়ারচর (নান্যেচর) এর সাপ্তাহিক বাজার দিন। তাই স্বাভাবিকভাবে দুর-দূরান্ত থেকে বাজারে এসেছিল শত শত জুম্ম শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। ১৭ নভেম্বর যেহেতু ছাত্রদের বেঁধে দেয়া শেষ সময়, তাই ছাত্ররা সেই দিন বেলা ১২ টায় মিছিলের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ছাত্রদের সাথে যোগ হয় জনতাও। ঠিক বেলা ১২ টায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে মিছিলটি স্থানীয় লাইব্রেরী প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়। যাদের প্রধান দাবীগুলো ছিল, যাত্রী ছাউনি থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহার, পিসিপি’র (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ) ৫দফা দাবী মানাসহ গণধিকৃত জেলা পরিষদ বাতিলের দাবী। কয়েক হাজার পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে স্লোগানে উজ্জীবিত। মিছিল থেকে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবী উচ্চকন্ঠে জানানো হচ্ছিল। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে কৃষি ব্যাংক এর সামনে সমাবেশ করে। অন্যদিকে বাঙ্গালী অনুপ্রবেশকারীদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদও একটি জঙ্গী মিছিল বের করে। তারা মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান তুলতে থাকে। এক পর্যায়ে সেটেলার গণপরিষদের মিছিল থেকে হামলা করে এক বৃদ্ধ পাহাড়ী বৌদ্ধকে আহত করা হয়। এতে করে জুম্মদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এক পর্যায়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয়বাহিনী ও সেটেলাররা। ফলে ঘটে যায় বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড।


ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি : ১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে সংঘটিত এই বর্বর গণহত্যায় ২৯ জন নিহত হয় এবং জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ, আহত হয় শতাধিক। এই জঘন্য বর্বর গণহত্যায় রাষ্ট্রীয়বাহিনীর বন্দুক গর্জে উঠেছিল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মিছিলে,রাষ্ট্রীয়বাহিনীর পরিকল্পিত ইশারায় সেদিন ধারালো দা, বর্শা, বল্লম নিয়ে নানিয়াচর বাজারে আগত নিরিহ পাহাড়ী বৌদ্ধদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বগাছড়ি, বুড়িঘাট থেকে আগত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী সেটেলাররা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল পাহাড়ী বৌদ্ধদের ২৭টি বসত বাড়ি। নানিয়াাচর বাজারে পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র, জনতার শান্তিপুর্ন মিছিলে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বাঙ্গালি সেটেলার ও রাষ্ট্রীয়বাহিনী হত্যা যজ্ঞ চালায়। এই বর্বর গণত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটেলারদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদের নেতা মোঃ আয়ুব হোসাইন, প্রাক্তন চেয়ারম্যান বুড়িঘাট, তৎকালীন বুড়িঘাট ইউ,পি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, নানিয়াচর জোনের জোন কমান্ডার মেজর সালাউদ্দিন। এতে নিহত হয় ২৯ জন পাহাড়ী বৌদ্ধ নাগরিক আহত হয় শতাধিক। এতে জুম্ম ছাত্ররা যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে তখন সেনা ক্যাম্প হতে জুম্ম ছাত্রদের উপর এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করা হয়। এক পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী বাঙ্গালীদের মিছিল থেকে দা, বল্লম ইত্যাদি দিয়ে হামলা হলে জুম্ম ছাত্র সমাজ জনতাকে নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ করে। এতে সেটেলার বাঙ্গালীরা পিছু হটলে কর্তব্যরত আর.পি ল্যান্স নায়ক জুম্ম জনতার উপর ব্রাশ ফায়ার করেন। এতে মূর্হুতের মধ্য ৮জন জুম্ম ছাত্র শহীদ হন। গুলিতে আহত হন অনেকে। এতে জুম্মদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হওয়া জুম্মদের উপর ঝাপিয়ে পরে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয়বাহিনী ও বাঙ্গালী সেটেলাররা। সেনাবাহিনীর বন্দুকের আঘাতে মূর্মুষ করার পর কাপুরুষেরা অনেককে পশুর মত জবাই করেছে। অনেকে কাপ্তাই লেকের পানিতে ঝাঁপিয়েও প্রাণ বাচাঁতে পারেনি। জেট বোট ও নৌকার উপর থেকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনেককে। যারা পাহাড়িদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল তাদেরকে টেনে হিচড়ে বের করে হত্যা করা হয়েছে অথবা পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশের জুম্ম গ্রামগুলি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সময় রাঙ্গামাটি থেকে আসা লঞ্চ পৌঁছালে সেখানেও হামলা করে অনেককে হতাহত করা হয়। এতে ভদ্রিয় নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেন। এভাবে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় জুম্মদের উপর।


বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঢাকায় মিছিল: নানিয়াচর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ঢাকায় মৌন মিছিল করেন। এটি ছিল পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের রাজধানী বুকে প্রথম মৌন মিছিল। এ মৌনমিছিলে অংগ্রহকারী এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেন, এ হত্যাকান্ডে শ্রীমৎ ভদ্রিয় মহাথের নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু গুরুতর আহত হন। তখন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি পদে ছিলেন শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের। এ মৌন মিছিলে প্রায় তিনশত জন বৌদ্ধ ভিক্ষু অংশগ্রহন করেন। জাতীয় শহীদ মিনার হতে প্রেসক্লাবে গিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সভার মাধ্যমে শেষ হয়। এ সংক্ষিপ্ত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে ভিক্ষুসংঘ হতে শ্রীমৎ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে দোষী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে বক্তব্য প্রদান করেন। তিন পার্বত্য জেলা হতে ঢাকার বুকে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু এ মিছিলে অংশ গ্রহন করে। শান্তপ্রিয় বৌদ্ধদের উপর অথ্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে রাজ পথে নামতে বাধ্য হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, এই গণহত্যার হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও সরকারে পক্ষ থেকে নিহতের ২০ জন বলে জানানো হয়েছিল। সেই সময়ের পত্রিকা মারফত এই সংখাকে ২৭ বা তারও বেশী বলে দাবী করা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী জুম্মরা এই সংখ্যা শতাধিক বলে জানিয়েছেন। যেহেতু ঘটনার পর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল, তাই প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ বার বার উঁকি মারে। গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষন এই সব মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ বার বার প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক, বেসামরিক, প্রশাসক ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা।


তথ্যসূত্র: (১) জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন ১৫,৩য় বর্ষ, শুক্রবার, ৩১শে ডিসেম্বর,১৯৯৩ ইং। (২) সিএউটিবিডি ডটকমনেট, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা” ০৯ নভেম্বর, ২০১১ইং। (৩) জনকন্ঠ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং । (৪) প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৫) দৈনিক পূর্বকোণ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৬) দৈনিক আজাদী, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং ।

Tags: ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

ঐতিহাসিক নানিয়াচর গণহত্যাঃ প্রসিত খীসা ও তার অনুগামীদের একঘেয়েমির ফল।
খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)- এর তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu