হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন

খাগড়াছড়িপার্বত্য চট্টগ্রাম

আহ্বায়ক মায়া চৌধুরি ও সদস্য সচিব রিতা চাকমা

ভ্যানগার্ড, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্রী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অন্যতম সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে।

“নারী মুক্তি আন্দোলন- তথা জুম্ম জনগণের অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদার করুন” এ স্লোগানে আজ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুরের জেবিসি রেস্টুরেন্টে এ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ডায়না চাকমার সঞ্চালনায় ও প্রস্তুতি কমিটির সদস্য মায়া চৌধুরিরর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য শ্রীমতি রত্না তঞ্চঙ্গ্যা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি সোনামনি চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুজন চাকমা (ঝিমিট)।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক সুভাষ চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক কৃতিত্ব চাকমা, কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক নিশান চাকমা প্রমূখ।

শুরুতেই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী এমএন লারমাসহ সকল বীর শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট মৌনব্রত পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রস্তুতি কমিটির সদস্য প্রত্যাশী চাকমা। স্বাগত বক্তব্যে প্রত্যাশী চাকমা বলেন, ১৯৮৮ সালের ৮ই মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী গৌরি চাকমা ও শিলা চাকমার নেতৃত্বে হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠিত হয়েছিল। এরপর হতে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠনতন্ত্র মোতাবেক বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসমূহের ভেদাভেদ, বৈষম্য ও বঞ্চনা দূরীকরণ, সমাজে নারীদের সমধিকার প্রতিষ্ঠা, জুম্ম নারী সমাজে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি করাসহ জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে এসেছে। এই সংগঠনে জড়িত থাকা অবস্থায় পাহাড়ের অগ্নিকন্যা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে। তার প্রতিবাদী সত্ত্বাকে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ভয় পেয়েছিল এবং এখনো ভয় পায়, যার কারণে এখনো কল্পনা চাকমার গ্রাফিতি রাষ্ট্রযন্ত্র মুছে দিচ্ছে। আমরা কল্পনা চাকমার উত্তরসূরী হওয়ার জন্য সংগঠনে যুক্ত হতে এসেছি। কল্পনা চাকমার অবাস্তবায়িত স্বপ্নগুলো পরিপূরণে আমরা বদ্ধপরিকর থাকবো।

অতিথি বক্তব্যে সুজন চাকমা বলেন, দেশে জরুরি অবস্থার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি বিভক্তির ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে আমাদের এই সংগঠনে ঐতিহাসিক এই সংগঠনের কমিটি আমরা করতে পারিনি। আজকে আমরা দেশের এমনি একটি পথ পরিবর্তনের সময়ে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে যাচ্ছি যখন স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এবং ছাত্র সমাজের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পৃথিবীতে আদিম সাম্যবাদী সমাজ হতে বর্তমান পর্যন্ত সমাজ সভ্যতার যে ক্রমবিকাশ তার সবখানেই নারি-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে অতীতেও জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিল। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে রাজপথে যেমনি অধিকারের প্রশ্নে লড়াই সংগ্রাম হয়েছিল আগামী দিনের লড়াই সংগ্রামেও আমরা এই নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি গণ জোয়ার সৃষ্টি হবে।

প্রধান অতিথি বক্তব্যে রত্না তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। সুতরাং নারী সমাজকে পিছিয়ে রেখে কেউ কখনো এগিয়ে যেতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবেনা। নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে নিজেদের সোচ্চার হতে হবে, সচেতন হতে হবে। সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক সহ রাষ্ট্রের সকল স্তরে নারীদের উপর বৈষম্য দূরীকরণে ছাত্রী সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে। আজকে লাভ জিহাদের ফাঁদে ফেলে জুম্ম নারীদের মুসলিম বানানো হচ্ছে, ধর্মান্তরিতকরণের মাধ্যমে আমাদের সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। নারী মুক্তি বিষয়ে সচেতন হতে হবে, চীনে নারী পাচার রোধে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদেরকে জাতিগত নির্মুলীকরণের বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে নীলনকশা সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত জুম্ম নারীদের উপর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং রুখে দাঁড়াতে হবে। আমি মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে এই আশা দিচ্ছি যে, আগামী দিনে আমরা একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাবো এবং বিভিন্ন বিষয়ে মহিলা সমিতি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পাশে থাকবে।

সবশেষে, মায়া চৌধুরিকে আহ্বায়ক ও রিতা চাকমাকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বাবায়ক কমিটি ঘোষণা করেন, মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য শ্রীমতি রত্না তঞ্চঙ্গ্যা।

এরপর সভাপতি বক্তব্যে মায়া চৌধুরী বলেন, আমরা জানি নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যুগের পর যুগ অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। পুরো পৃথিবীতে নারীরা কোথাও নিরাপদে নেই। প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিসহ, পারিবারিক নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন নারীরা। তার অধিক এখানকার আমাদের জুম্ম নারীদের উপর সেটেলারদের কর্তৃক যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং
ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে- এখনো হচ্ছে। একদিকে জুম্ম নারীদের উপর বৈষম্য, নির্যাতন, শোষন, বঞ্চনা অন্যদিকে জুম্ম জনগণের জাতীয় ও জন্মভূ মির অস্তিত্ব সংকট। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে আজকের এই আহ্বায়ক কমিটি গঠন হলো। আমি এই নবগঠিত কমিটির আহ্ববায়ক হিসেবে নারী সমাজের উপর যে শোষন-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন তার বিরুদ্ধে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাামে জনসংহতি সমিতির সকল কর্মসূচীর সাথে একাত্ম ঘোষণা করছি। আমাদের এই আহ্ববায়ক কমিটি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র সর্বদা মেনে চলবো এবং গঠনতন্ত্র মোতাবেক সংগঠনের নীতি-আদর্শ মেনে সকল উদ্দেশ্যে-লক্ষ্য পরিপূরণে সচেষ্ট থাকবো। এই আহ্ববায়ক কমিটির মাধ্যমে আগামীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা, থানাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমতলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শাখা কমিটি গঠনের প্রচেষ্টা থাকবে এবং যতদ্রুত সম্ভব কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত করণের জন্য প্রচেষ্টা থাকবে।

কল্পনা চাকমার সুরে মায়া চৌধুরি বলেন- “বেগম রোকেয়া যেভাবে ঘুণে ধরা সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা যেমনি কাঁধে অস্ত্র তুলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন- জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেভাবে জুম্ম নারী সমাজকে জাগাতে হবে। স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।” মায়া চৌধুরি, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নবগঠিত কেন্দ্রীয় আহ্ববায়ক কমিটির পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ পুরো বিশ্বের নারীদের উপর সকল নির্যাতন, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের বিচারের দাবী জানান।

Tags: , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

পানছড়িতে ইউপিডিএফ কর্তৃক যুব সমিতির সদস্যের পরিবারকে হুমকির অভিযোগ
কাপ্তাই হ্রদের পানি অব্যাহতভাবে বাড়ার কারণে বাঁধের জলকপাট খোলা হলো ৪ ফুট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu