ভ্যানগার্ড ডেস্ক
১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের কাছে এক বিভীষিকাময় দিন। আজ থেকে ৩০ বছর আগে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাংয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্ম গুচ্ছগ্রামে এক নির্মম-বর্বর হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। যা লোগাং গণহত্যা নামে সকলের কাছে পরিচিত। পাহাড়ে বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ উৎসব বিজু, বিষু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিহুর তিন দিন আগে সংঘঠিত হয়ে গেলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক ভয়ংকর নারকীয় হত্যাকান্ড।
লোগাং গুচ্ছ গ্রামে দু’জন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গরু চড়ানো এক জুম্ম নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। নারীটি নিজেকে রক্ষার জন্য চিৎকার দেয়ায় এক জুম্ম ভদ্রলোক সেখানে গিয়ে ধর্ষকদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়, কিন্ত ধর্ষকরা বিপরীতে উক্ত লোকটিকে হামলায় মেরে ফেলে ও লাশটি সেখানে রেখে পার্শ্বর্বর্তী বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) ব্যারাকে অবস্থান নেয়।
সেনাবাহিনী ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না করে ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় দেওয়ার জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকে আহত করে ও এর জন্য শান্তিবাহিনীকে দোষারোপ দেয়। এরপর শান্তিবাহিনী ধরার অজুহাতে সেনাবাহিনী, বিডিআর (বিজিবি), আনসার-ভিডিপির সহযোগীতায় সেটেলার বাঙালিরা এ হত্যাকান্ড চালায়। সেটেলাররা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে জুম্মদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনী, বিডিআর (বিজিবি), আনসার-ভিডিপি মিলে নির্বিচারে জুম্মদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এতে প্রায় ৮০০ জুম্ম ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়, ১৫০০ অধিক জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদের শিকার হতে হয়। উক্ত হত্যাকান্ডে স্থানীয় জুম্মদের মতে প্রায় ১২শত জুম্ম নর-নারী-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিহত হন। উচ্ছেদ হওয়া জুম্মরা বাঁচার তাগিদে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এই নৃশংস হত্যাকান্ডের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজু, বিষু, বিহু, সাংগ্রাই, বৈসুর আনন্দ শোকে পরিণত হয়। ৯২’ সালের ১৩ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি হাজার হাজার লোক রাজপথে বিক্ষোভে নামে। ঢাকা থেকে আগত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিক বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন। প্রদীপ জ্বালিয়ে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণ করা হয়।
ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, লেখক-সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যেতে চাইলে নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের বাঁধা দেয় পানছড়ি উপজেলার সেনাবাহিনী। প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আইনজীবী সারা হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ সহ ২২ জন ঢাকায় ফিরে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে জানানো হয়, খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতঃই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি ঘটনার সত্যাসত্য জানবার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ই এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাপ্রাপ্ত হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বলে নিরাপত্তাবাহিনী আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধা প্রদান করে। ফিরবার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহুসংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যাক্তির সাথেও আমাদেও কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৮ই এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এক শোক মিছিল আয়োজন করে। উক্ত মিছিলে শতাধিক পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হতে মিছিল সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবে যায়। প্রেস ক্লাবের সম্মুখে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে আবারও মিছিল সহকারে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় তেঁজগাও-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মিছিলটি বাংলা মোটরে এসে পৌছলে পুলিশ বাঁধা প্রদান করে। সেখান থেকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পুলিশের জীপে করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লোগাং-এর হত্যাকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। লোগাং-এ নিহতদের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে লোগাং- এর উদ্দেশ্যে মৌন পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই পদযাত্রা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে আগত হাজার হাজার ছাত্র জনতা অংশ গ্রহণ করে। ঢাকা থেকে বাসদ নেতা আব্দুল্লাহ সরকার এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নেতা নূর আহমেদ বকুল, রুহিন হোসেন প্রিন্স, আব্দস সাত্তার খান সহ অনেক ছাত্র নেতা ও সাংবাদিক এ পদ যাত্রায় সামিল হন। ১০ এপ্রিল লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত হওয়া গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পুস্পস্তবক অর্পন করে এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। এরপর সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সভা হয়। এতে সবার পক্ষে বক্তব্য রাখেন জনাব আব্দুল্লাহ সরকার।
আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা শোকে বিভোর হয়ে স্মরণ করে সেই লোগাং গণহত্যার ইতিহাসকে। লোগাং গণহত্যার আজ ৩০টি বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু আজও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এযাবতকালে জুম্মদের উপর ১৩টির অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু একটি গণহত্যারও বিচার পায়নি জুম্মরা। বরং বিচার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে বারবার হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। এখনও জুম্মদের ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে জুম্মদের উপর স্টীম রোলার চালু রাখা হয়েছে।