নৃশংস লংগদু হামলার ৬ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রামরাঙ্গামাটি

সিএইচটি ভ্যানগার্ড

২রা জুন ২০১৭,লংগদু হামলা:
১লা জুন বৃহস্পতিবার দুপুরে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ৭নং ইউনিয়ন শাখার যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম নয়ন (৩৫)-এর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ লাশটি উদ্ধার করা হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার চার মাইল এলাকা থেকে৷ স্থানীয় পুলিশ জানায়, দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যার পর লাশ ফেলে রেখে যায়৷ তিনি একজন ভাড়াটে মোটর সাইকেল চালক ছিলেন বলে জানা যায়।এরপর থেকেই লংগদু উপজেলা সদরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷

২জুন শুক্রবার সকাল ৮ টার দিকে লাশ লংগদুতে নিয়ে আসা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷ হত্যাকান্ডের দায় ছাপিয়ে দেয়া হয় পাহাড়ীদের উপর। হামলা চালানো হয় পাহাড়ী জনপদে। এ হামলায় লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট; মানিকজুরছড়ায় কমপক্ষে ৪০টির অধিক ঘরবাড়ি, এবং বাত্যা পাড়ায় প্রায় ৪০টি ঘরাবাড়িসহ জুম্মদের প্রায় ৩০০টির অধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ছত্রছায়ায় লংগদু উপজেলায় বাত্যা পাড়া থেকে সেটেলার বাঙালিদের এক জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি আনুমানিক ১০টার দিকে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় পৌঁছলে সেটেলার বাঙালিরা কোন উস্কানী ছাড়াই জনসংহতি সমিতির অফিসসহ জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ঘরবাড়ি লুটপাটসহ জুম্মদের উপর হামলা করতে শুরু করে। এতে তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের ২০০-এর অধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয় বলে জানা যায়। এরপর সেনা ও পুলিশ প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী মানিকজুরছড়ায় হামলা করতে যায়। এতে জুম্মদের বসতিতে অগ্নিসংযোগ করলে কমপক্ষে ৪০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। বেলা ১২টার দিকে স্থানীয় প্রশাসন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা দক্ষিণ মানিকজুরছড়া, বাত্যা পাড়া ইত্যাদি জুম্ম গ্রামে অগ্নিসংযোগ করেছিল বলে জানা গেছে। বাত্যা পাড়ায় আরো ৩০টি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়।

লাশ নিয়ে সেটেলারদের জঙ্গী মিছিল বের করার খবর ১লা জুন বৃহস্পতিবার রাতে জানাজানি হলে স্থানীয় জুম্ম জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ লংগদু সেনা জোন ও লংগদু থানা কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার কথা জানা্নো হয়েছিল। ২রা জুন সকালে সেনা জোনের পক্ষ থেকে টুআইসি মেজর রফিক জুম্মদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘মিছিল করা সেটেলারদের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলটি করবে। কোন অঘটন ঘটতে দেয়া হবে না।’ তাই নিরাপত্তা নিয়ে জুম্মদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে জুম্ম জনপ্রতিনিধি ও জুম্মদেরকে তিনি আশ্বস্থ করেন। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক যে, লংগদু সেনা জোনের জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল আবদুল আলিম চৌধুরী পিএসসি, টুআইসি মেজর রফিক ও লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা-পুলিশের সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে সেটলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়।


উক্ত জঙ্গী মিছিল ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পাটি, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি জাতীয় রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে এবং সাম্প্রদায়িক উগ্র সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন ও অন্যান্য সেটেলার বাঙালিদের সংগঠনের লোকজন অংশগ্রহণ করে বলে জানা যায়। সেনা জোন ও থানার পক্ষ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করা সত্ত্বেও এবং তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে জুম্মদের ঘরবাড়িতে সেটেলার বাঙালিদের অবাধে এই অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলার ঘটনা থেকে এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, সেনা-পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের যোগসাজশে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে সেটেলার বাঙালিরা লাশ নিয়ে মিছিল করার আয়োজন করেছিল। যদিও উক্ত ঘটনায় পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ঘরবাড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। উক্ত হামলার ঘটনায় গুণবালা চাকমা নামে একজন জুম্ম নিহত হওয়ার খবর জানা যায়।

১৯৮৯ এর গণহত্যার পর লংগদুতে এটিই ছিল আদিবাসীদের উপর সবচেয়ে বড় হামলা।

এদেশের আদিবাসীরা স্বাধীনতার পর হতে নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার পাবার জন্য আন্দোলন,দাবী করে গেলেও বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার না দিয়ে তাদেরকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে।বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে পার্বত্য চটতগ্রামকে নিয়ে এদেশের শাসকশ্রেণী বেশী উঠেপড়ে লেগেছে । একসময়কার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে জিয়াউর রহমানের আমলে ৮০’র দশকে সমতল থেকে প্রায় ৫ লক্ষ সেটলার বাঙালীকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এখানকার ভূমিপুত্রদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করে।যার কারণে পাহাড়ে আজ আদিবাসী-বাঙালী অনুপাত ৪৮%-৫২%। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামীকরণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার অনবরত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। যার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনাকালে সাংসদ আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার প্রস্তাবকৃত “বাংলাদেশের সকল নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবে” প্রস্তাবটি শুধুমাত্র সংখ্যা গরিষ্ঠতার কারণে গ্রহণ করা হয়েছিল এদেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের অস্বীকার করে।

২০১১ সালের ৩০শে জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবারও বাংলাদেশের ভিন্ন জাতিসত্বার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র এক জাতির(বাঙালী) রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধান ঘোষণা করে। এই যে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আদিবাসীদের উপর যে হামলা,লুটপাত,হত্যাকান্ড,ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ সবগুলোই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কিছু ঘটনা। সংবিধানই যখন আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তখন তাঁদের উপর এসব ঘটনা ঘটা মানেই এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের দোষ বলে আদিবাসীরা মনে করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পর হতে আজ পর্যন্ত আদিবাসীদের উপর প্রায় ডজনের অধিক গণহত্যা চালানো হয়েছে, হামলা-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৫০টিরও বেশী। কিন্তু জুম্ম আদিবাসীরা সেসবের কোন সুষ্ঠু বিচার আজো পায়নি।

Tags: , , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

সার্বিক পরিস্থিতি ও শৃঙ্খলা বিষয়ে খাগড়াছড়ি সদরের দেওয়ান পাড়ায় জেএসএসের সাংগঠনিক সভা
জেএসএস’র নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিতঃ সভাপতি বিমল কান্তি চাকমা, সাধারণ সম্পাদক অংশুমান চাকমা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu