দুই সম্প্রদায়ের প্রথম দুই স্নাতক

দেশপার্বত্য চট্টগ্রাম

অনলাইন ডেস্ক

লেলুং খুমি আর কাইংওয়াই ম্রোর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ দুজন। একজন খুমি সম্প্রদায়ের, অন্যজন ম্রো। দুজনের প্রতিবন্ধকতা জয়ের গল্পও প্রায় একই। মিল আছে অর্জনেও—লেলুং ও কাইংওয়াই নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রথম স্নাতক।

খুমিদের লেলুং

মুঠোফোনে প্রথমেই শোনা হলো লেলুং খুমির ছেলেবেলার কথা। বান্দরবানের কেওক্রাডং পর্বতের পাদদেশের খোলাইনপাড়া থেকে জীবনের যে পথে অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন, সেই পথ মাড়ানোর অদম্য গল্প।

লেলুং খুমি

খোলাইনপাড়ার নামটির সঙ্গে মিশে আছে লেলুং খুমির দাদার নাম। এই পাড়াতেই বেড়ে ওঠা লেলুংয়ের। বয়স যখন ৮ বছর, তখন একদিন ঘটল ‘অভূতপূর্ব’ এক ঘটনা। লেলুং খুমি বললেন, ‘বাবা রীতিমতো আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রুমা বাজারে (বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদর) নিয়ে গেলেন। নতুন পোশাক কিনে দিলেন। ব্যাগ কিনে দিলেন। যে ব্যাগের মর্মার্থ পরদিন বুঝেছিলাম।’

সেদিন নতুন অনেক কিছু পাওয়ার আনন্দ ছিল লেলুং খুমির মনে। বাবার হাত ধরে রুমা বাজারের অলিগলি ঘুরে বেড়ানোও বাড়তি পাওয়া ছিল তাঁর কাছে। ভেবেছিলেন, বাড়ি ফিরে সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে এসব গল্পের মতো করে বলবেন। কিন্তু বাবা-ছেলের সঙ্গে আরও একজন মানুষ ছিলেন। লেলুং খুমির পূর্ণ মনোযোগ তখন তাঁর দিকে। কারণ, লেলংয়ের বাবা কী একটা কাজে বাজারের অন্য দিকটায় গেছেন।

লেলুংয়ের বাবা সেই যে গেলেন, আর ফিরলেন না। সঙ্গের সেই মানুষ তাঁকে নিয়ে গেলেন এক বাড়িতে। তাঁর ভাষা ভিন্ন। লেলুং বুঝলেন এটা ভিন ভাষায় কথা বলা সেই মানুষের বাড়ি। বাড়িতে আছেন আরও অনেকে। কিন্তু কারও কথা তিনি বোঝেন না। তবে পরিবারের মানুষের আদরযত্ন অনুভব করতে পারলেন। কিন্তু লেলুং খুমির মন বাবার অপেক্ষায়, খোলাইনপাড়ায় ফেরার দুর্গম পথটায়। রাত বাড়ল। লেলুংয়ের কান্নাও বাড়ল। দানাপানি কিছুই মুখে রুচল না।

লেলুং খুমি বলেন, ‘বাবা আমাকে রেখে এসেছিলেন এক মারমা পরিবারে। আগে থেকেই সব ঠিক করা ছিল। বললে রাজি হব না জেনে, কৌশলে এভাবে রেখে যান।’

সকালে লেলুংকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় এক স্কুলে। স্কুলের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো। ক্লাসে বসে বুঝলেন তিনি কারও ভাষা বুঝতে পারেন না। লেলুং বলেন, ‘মাতৃভাষা খুমি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বুঝতাম না। স্কুলসহ মারমা পরিবারে এক নিদারুণ কষ্টের দিন শুরু হয়েছিল আমার।’

মারমা পরিবারে এভাবে দুই বছর কাটে লেলুং খুমির। তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত রুমা আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাঁকে।

আবাসিক স্কুল থেকে ১৯৯৮ সালে এসএসসি পাস করেন লেলুং। এরপর ফিরতে হয় কেওক্রাডংসংলগ্ন খোলাইনপাড়ায়। পরিবারের বড় সন্তান। বাবারও বয়স হয়েছে। লেলুং জুমচাষি বাবার পাশে দাঁড়ান। জুমের কাজ করতে গেলেও মন পড়ে থাকত কলেজে ভর্তির চিন্তা। পরিবার থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, বিয়েথা করে সংসারের হাল ধরার। অনগ্রসর খুমি সম্প্রদায়ে এই তো চিরাচরিত ঘটনা। কিন্তু লেলুং সেই প্রচলিত পথে হাঁটলেন না। তিনি ভর্তি হলেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া বারো আউলিয়া ডিগ্রি কলেজে।

চট করে কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা বলা হলো বটে। লেলুংয়ের জীবনগল্পে সে আরেক অধ্যায়। উপস্থিত না থেকেও যেন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন এমন কলেজের খোঁজ করতে গিয়ে লোহাগাড়ার সে কলেজে যাওয়া। কলেজ নির্বাচন করলেও ভর্তির খরচ জোগানোর আর্থিক সংগতি তাঁর পরিবারের ছিল না। তখন এক চাচা এগিয়ে আসেন সহযোগিতা করতে। তিনি ব্যবস্থা করেন ১২০ টাকার। দিনভর হেঁটে গিয়ে সে টাকায় ভর্তি হয়েছিলেন কলেজে। স্থানীয় এক বাড়িতে লজিংয়ের ব্যবস্থা করে থেকেছিলেন কয়েক মাস। কিন্তু তিন বেলা খাওয়া ছাড়াও যে খরচাপাতির প্রয়োজন হয়, সে অর্থ লেলুংয়ের ছিল না। তাই ফিরতে হয়েছিল গ্রামে। হাত লাগাতে হয়েছিল জুমচাষে।

নিজ গ্রাম খোলাইনপাড়ায় লেলুং খুমি

কলেজে অনিয়মিত হয়ে প্রথমবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন লেলুং। মন খারাপ হলেও হাল ছাড়লেন না। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় খুমি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন লেলুং। স্বপ্ন আকাশ ছোঁয় লেলুংয়ের। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুঁতে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করেন। কোটায় ভর্তির আবেদন করেন। কিন্তু কোথাও ভর্তির সুযোগ হয় না। ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোয় ‘লেলুং কি উচ্চ শিক্ষা পাবে না?’ শিরোনামে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এরপর স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন বান্দরবান সরকারি কলেজে। দুই বছর পর চলে আসেন ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে।

তত দিনে পরিচয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডর্টমুন্ড কলেজের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসনের সঙ্গে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করছিলেন এই অধ্যাপক। তাঁকে খুমি ভাষার গবেষণার কাজে সহযোগিতা করেন লেলুং। ২০০৫ সালে ডেভিড এ পিটারসনের সঙ্গে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। লেলুং খুমি বলেন, ‘সেটাই ছিল আমার জীবনের বাঁকবদল।’

জীবনের মোড় ঘুরে যায় লেলুং খুমির। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকারের একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের ২০ জন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীকে সে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়। লেলুং খুমি তাঁদের একজন। অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক হয়ে ফিরে আসেন দেশে। ২০১০ সালে দেশে ফিরে নিজ সম্প্রদায় এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য লেলুং কাজ করে চলেছেন। কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে। সর্বশেষ গত মার্চ মাস পর্যন্ত কাজ করেছেন হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি বেসরকারি সংস্থায়। এখন থাকছেন বান্দরবানে। দেশে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ার সময় গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন খামলো খুমির সঙ্গে। এখন তাঁদের ঘরে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানদের অনুপ্রেরণা বাবা লেলুং।

রোল মডেল হতে চান কাইংওয়াই ম্রো

দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের যাঁরা নিজেদের দেশে-বিদেশে মেলে ধরছেন, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষদের, এমন কয়েকজনের প্রতিকূলতা পেরোনোর কাহিনি ফেসবুকে লিখেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। কাইংওয়াই ম্রো তাঁদের একজন। অবিমিশ্র ম্রোদের মধ্যে কাইংওয়াই প্রথম স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এ তথ্যটুকু নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার লেখা থেকেই পাওয়া। সঙ্গে লেখায় আভাস দিয়েছেন কাইংওয়াইয়ের অদম্য জীবনেরও।

কাইংওয়াই ম্রো

ম্রো সম্প্রদায়ের কাইংওয়াই ম্রো এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা। স্ত্রী-সন্তানেরা বান্দরবানে থাকলেও পেশাগত কারণে তিনি থাকেন রাঙামাটি শহরে। পরিচয়পর্বের পর, মুঠোফোনের এ প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে শুনতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিকূলতা জয়ের কথা। যার শুরুটা বান্দরবান সদর উপজেলার চিনিপাড়ায়। এ গ্রামেই জন্ম কাইংওয়াইয়ের।

গণকের কথায় বান্দরবান

বান্দরবান থেকে এক সকালে বাড়ির পথ ধরেছিলেন ছোট কাইংওয়াই ম্রো। কাইংওয়াইদের গ্রামটা বান্দরবান সদর উপজেলা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে। হেঁটে তিনি যখন গ্রামে পৌঁছালেন, তখন বিকেল গড়িয়েছে। বাড়ি ফেরার যে উচ্ছ্বাসে গ্রামে পা রেখেছিলেন, একলহমায় হারিয়ে ফেললেন মানুষের শোকবিহ্বল দৃষ্টিতে। কাইংওয়াই ম্রো জেনে গেছেন, তাঁর মা আর নেই।

মাচাং ঘরে বসে তাঁর মনে পড়ছিল মাস কয়েক আগে বাড়ি ছাড়ার কথা। যেদিন শেষবারের মতো মায়ের পাশে বসেছিলেন, নিয়েছিলেন বিদায়। যে বিদায়ে ভূমিকা ছিল পাড়ার এক গণকের। তিনিই কাইংওয়াই ম্রোর বাবাকে বলেছিলেন ছেলেকে গ্রামের বাইরে রাখতে। অকালে ছেলে হারানোর আশঙ্কায় কাইংওয়াইয়ের বাবা তাঁকে রেখে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত বান্দরবান সদরের ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়েই স্বপ্ন বোনেন কাইংওয়াই। নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদের স্নেহ আদায় করেন। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে শুধু নিজের নয় শিক্ষকদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেন। ১৯৯৯ সালে বিদ্যালয়টি থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি।

নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে কাইংওয়াই ম্রো

জীবনবৃত্তান্তের মতো শিক্ষাজীবনের কথা বলে গেলেন কাইংওয়াই ম্রো। পিছিয়ে পড়া এক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়ে অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকলেন তরুণদের। তিনি বলছিলেন, ‘আমার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আর যেন পিছিয়ে না থাকে, সে চেষ্টাই করতে থাকি তখন থেকে। এখন অনেক ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তাঁরা ভর্তি হচ্ছেন নিজের যোগ্যতায়।’

এগিয়ে চলার দিনগুলো

শিক্ষক আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় কাইংওয়াই ম্রো এলেন ঢাকায়। তিনি বলছিলেন, ‘সেটাই আমার প্রথম ঢাকায় আসা। এই হারিয়ে যাব ভেবে হোস্টেল থেকে বেরই হতাম না।’ উচ্চমাধ্যমিকে নটর ডেম কলেজে ভর্তির পর কাইংওয়াই ম্রোর সময় এভাবেই কাটতে থাকল।

নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৮ সালে স্নাতক পড়ার সময় গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ডর্টমুন্ড কলেজের ম্রো ভাষার এক অধ্যাপকের গবেষণা সহকারী হিসেবে এক বছর কাজ করেন। ফিরে এসে সম্পন্ন করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। এরপর ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন লা ট্রোবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কমিউনিটি প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ২০১২ সালে ফিরে আসেন দেশে।

কাইংওয়াই ম্রোর বিদেশে থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। হয়তো পরিবার নিয়ে উন্নত দেশে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু কাইংওয়াই স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নেওয়ার। সে কাজটিই এখন করছেন। তাই তো বললেন, ‘আমার পিছিয়ে পড়া ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আমি রোল মডেল হতে চাই।’

সূত্রঃ প্রথম আলো

Tags: , , , ,

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট

বড়গোপটিলার গারো মাঠ গারোদেরই থাকলো, খেলতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে
Bandarban dist council destroys hills, builds road for private university

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fill out this field
Fill out this field
Please enter a valid email address.
You need to agree with the terms to proceed

Menu