জোবাইদা নাসরিন
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক বাঙালিদের কাছে বেড়ানোর পছন্দের জায়গা, প্রিয় জায়গা। অনেকেই ছুটিতে ছুটে যান পাহাড়ের কোলে, প্রকৃতির কাছে। কিন্তু এই পার্বত্য এলাকাতেই যখন নারী নিপীড়ন হয়, তখন কতজন বাঙালি তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন? আমি নিশ্চিত, খুব কম জনই এটা নিয়ে ভাবেন। ভাবেন না, কারণ এটি তাঁদের ভাবনাজগতের বিষয় নয়। জাতীয়তাবাদী আধিপত্যের সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা যখন একযোগে কাজ করে, তখন সেটিকে জাতিগত আধিপত্যের অস্ত্র হিসেবে হাজির হয়। এই কারণেই বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মনে যতটা দাগ কাটে, ঠিক ততটা আলোড়ন ওঠে না পাহাড়ি বা অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠির নারী ধর্ষণের ঘটনায়।
আমরা যখন সিলেটের গৃহবধূ গণধর্ষণের ভয়াবহতা এবং এই ধরনের জঘন্য কাজের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সিলেটের সেই ঘটনার ঠিক এক দিন আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির বলপিয়ে আদাম এলাকায় একজন চাকমা নারীকে নয়জন ধর্ষণ করেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই জানা যায়, ২০০৫ সালে ভাইকে এবং ২০০৬ সালে বাবাকে হারানোর পর থেকেই অসহায় এই নারী মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ ছিলেন।
ধর্ষকেরা পরিচিত। মেয়েটির আত্মীয়রা তাঁদের চেনেন। তাঁরা ওই এলাকার সেটেলার। একই এলাকার বলেই তাঁরা জানতেন মেয়েটি ভারসাম্যহীন; তাঁকে ধর্ষণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। নয়জন মিলে সেই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ধর্ষণের পর তাঁরা বাড়িতেও লুটপাট চালান।
দেশ যখন করোনার ভয়াবহতায় অনেকটাই থমকে গিয়েছিল, তখনো থেমে থাকেনি ধর্ষণসহ নারীর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা। গত দুই বছরে শিশু-কিশোরীসহ ৭ হাজার ৫০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গত মাসে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১৭২টি। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত আটজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বান্দরবানের লামায় এক ত্রিপুরা নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে মারমা এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া এক চাকমা ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও অভিযুক্ত ধর্ষককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহালছড়ির ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এভাবেই চলছে ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার-সালিস!
কৃত্তিকা ত্রিপুরা ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার বিচার আজও হয়নি। ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার নয়মাইল এলাকায় ১০ বছরের শিশু কৃত্তিকা ত্রিপুরা পূর্ণাকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মেয়েটি স্কুল থেকে দুপুরের বিরতিতে ভাত খেতে এসেছিল। তখনই সে ধর্ষণের শিকার হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। কৃত্তিকার ধর্ষণ এবং হত্যা নিয়ে সে সময় প্রতিবাদ, আন্দোলন হলেও সেটির বিচার এখনো হয়নি।
কেন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? কারণ পাহাড়ে এ পর্যন্ত ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো জঘন্য যত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগেরই সঠিক বিচার হয়নি। আন্দোলন এবং প্রতিবাদের মুখে দু-একজনকে গ্রেপ্তার করা পর্যন্তই রাষ্ট্র তার নড়াচড়া দেখায়। এরপর আর কিছুই হয় না। উল্টো মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারটি ভিটেমাটি ছেড়ে সেই এলাকা থেকে চলে যায়। তাতে আরও লাভ, সেই জমিও দখলে নেওয়া যায়। বিচার না হওয়ায় পাহাড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
পাহাড় থেকে সমতল—সব ধর্ষণেরই অতি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। কারণ, আমরা দেখেছি, এটি আসলে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক ক্ষমতা, জাতীয়তাবাদী আধিপত্য পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে অবস্থান নিচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে। এভাবে চলতে চলতে তক্কে তক্কে থাকা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা আরও প্রসারিতই হয়, ধর্ষণ বেড়েই চলে।
শেষ খবর এই, ওই ঘটনায় করা মামলায় খাগড়াছড়ি সদর, রামগড়, গুইমারা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেখা যাক তদন্তকাজ ও বিচার কত সময় নিয়ে, কতটা ন্যায্যতা নিয়ে হয়।
জোবাইদা নাসরীন
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail. com.
সূত্রঃ প্রথম আলো।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।