ভেনগার্ড ডেস্ক
রক্তিম চাকমা
ব্রিটিশ ভারতে শাসনের সুবিধার্থে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলকে আলাদা জেলায় রুপান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশরা এখানকার পাহাড়ী মানুষদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্রটা রক্ষার প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা (EXCLUDED AREA) হিসেবে ঘোষণা করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আলাদা একটি শাসন ব্যবস্থা চালু করে। যাকে আমরা “পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান ১৯০০” বা “CHITTAGONG HILL TRACTS REGULATION 1900 ACT” নামে জানি। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের সময় অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কোন এক অজানা কারণে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমরা জানিনা ৯৫% অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হলো! সেই তখন থেকেই পাহাড়ী জনগণের সাথে এ অঞ্চলের শাসকেরা প্রতারণা শুরু করেছিল, যা আজো চলমান। পাকিস্তান সরকারের সময়েই ১৯৫০ সাল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে বহিরাগত মুসলিম সেটেলার আনা শুরু হয়েছিল। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল শাসকেরা। পাকিস্তান সরকার সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের সময়ে গঠিত ফ্রন্টিয়ার পুলিশ বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে পাহাড়ী মানুষদের কাছ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেড়ে নেয়। এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে জাতিগতভাবে নির্মূলের ষড়যন্ত্র আজ অবধি চলমান। তারই অংশ হিসেবে ষাট দশকে পাহাড়ী মানুষদের মতামত না নিয়ে কাপ্তাই হ্রাইড্রোলিক বাঁধ দিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয় ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি, হাজার হাজার পাহাড়ী মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তখনকার পাহাড়ী সামন্তবাদী নেতৃত্ব এর প্রতিবাদ করতে ভয় পেয়েছিল। শুধুমাত্র এমএনলারমাই রুখে দাড়িয়েছিলেন এর বিরুদ্ধে, পাহাড়ী ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে লিফলেট, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলেন। যার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশদের দেয়া EXCLUDED AREA এর পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে TRIBAL AREA বা উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালে এমএনলারমা পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন এবং একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবী তোলা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে এমএনলারমা ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা বিপুল ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এমএনলারমার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাহাড়ী মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য গড়ে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”। জুম্ম জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষিত হয় পাহাড়ের অধিকারহারা জুম্ম মানুষেরা। বাংলাদেশের সংবিধান রচনার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক মর্যাদা রক্ষা ও এখানকার পাহাড়ী মানুষদের অধিকার যাতে সংবিধানে সংরক্ষণ করা হয় তার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী পেশ করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাহাড়ী নেতাদের কথা পাত্তা না দিয়ে অগ্রাহ্য করেন। সংবিধান রচনা হলো, লেখা হলো- ” বাংলাদেশের সকল জনগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবে”। তীব্র প্রতিবাদ করলেন এমএনলারমা, বললেন- ” একজন বাঙালি যেমন একজন চাকমা হতে পারেনা, তেমনি একজন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাও বাঙালি হতে পারেনা।” সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলেন! এমএনলারমার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ০৭ জানুয়ারি গোপনে গঠিত হলো জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা “শান্তিবাহিনী”। শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হলো, দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হলো, আত্মগোপন করলেন এমএনলারমা। শুরু হলো সশস্ত্র আন্দোলন।
দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদ সরকার, বিএনপি সরকার ও আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে বিভিন্ন সময়ে ২৬ বারের বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক চলা অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হলো, আকাশে উড়লো শান্তির কপোত। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামে শত্রুবাহিনী ও আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধে শহীদ হন জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ হাজার হাজার জুম্ম লড়াকু সৈনিক। এ বছর ২০২০ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দীর্ঘ ২৩ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যে চুক্তির মাধ্যমে জুম্ম জনগণ মনে করেছিল এবার বুঝি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। হাজার হাজার জুম্ম শহীদদের আত্মত্যাগ সফল হবে, পাহাড়ী মানুষেরা আশার স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো। ইউনেস্কো শান্তি পুরষ্কার লাভ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
না, পাহাড়ী মানুষদের সুখ সহ্য হলোনা পাহাড়ী দালালদের। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় হতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একটি জুম্ম স্বার্থবিরোধী অংশ চুক্তির বিরুদ্ধে স্লোগান তুললো। বিরোধী দল বিএনপির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পার্বত্য চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে চুক্তিকে বাতিলের জন্য দেশব্যাপী লংমার্চের মত কর্মসূচি পালন করা হলো। জুম্ম স্বার্থ বিরোধীদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে গড়ে তোলা হলো চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ। তোলা হলো পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের লোক দেখানো স্লোগান। শুরু হলো গৃহযুদ্ধ, থমকে গেল চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন। এক এগারোতে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে চুক্তি পক্ষীয় সংগঠন জনসংহতি সমিতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন আরো স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় বিশেষ বাহিনীরা জুম্মদের শক্তিকে বিভক্ত করে দিতে থাকে, জুম্মদের জাতীয় জীবনে কালো থাবা বসিয়ে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সরকার এই বিভক্তিকে ইস্যু করে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অকার্যকর করে রেখে দিয়েছে। জুম্মদের মাঝে বাঁধিয়ে দিয়েছে জাতীয় জীবনের অভিশাপ- ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত।
আজ চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছরের হিসাব নিকাশ করলে আমরা হতাশা-নিরাশা, না পাওয়ার আক্ষেপ, ভূমিহারা, ভস্মীভূত বাড়িঘর, স্বজন হারানোর কান্না, জুম্ম নারী ধর্ষণ, উন্নয়নের নামে প্রহসন এসবিই দেখতে পাই। তাহলে কি লাভ হলো এই চুক্তি স্বাক্ষর করে? চুক্তি পূর্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে চুক্তির পর তার অধিক এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে পাহাড়ী মানুষদের উপর। সরকার বলছে ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি ধারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে, ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে আর ৯টি ধারা বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৪টি ধারা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে, ৩৪টি ধারা স¤পূর্ণ অবাস্তবায়িত, আর ১৪ ধারা আংশিক বাস্তবায়িত। আজ চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩টি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে মাত্র ৭২টি ধারাই সরকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারি সরকারী দল আওয়ামীলীগ চুিক্ত স্বাক্ষরের পর চার-চার বার ক্ষমতায় এসেছে অথচ চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কোন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এগিয়ে আসেনি। জনসংহতি সমিতির একাংশের নেতা সন্তু লারমা সেজন্য বার বার আক্ষেপ করে বলে থাকেন চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে পাহাড়ী মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়, শুধুমাত্র অস্ত্রগুলো কেড়ে নেয়ার জন্য! একসময় সরকার পক্ষ বলেছিল চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল জনসংহতি সমিতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে কিভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হবে? এর জবাবে সদ্য প্রয়াত জনসংহতি সমিতির নেতা সুধাসিন্ধু খীসার বক্তব্য ছিলো- “চুক্তিতে কোন লেখা নেই যে জনসংহতি সমিতি বিভক্ত হলে চুক্তি বাস্তবায়ন হবেনা। জনসংহতি সমিতি ১৪ভাগ হতে পারে কিন্তু সরকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, বাস্তবায়নের দায়িত্বও সরকারের।” পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভারত প্রত্যাগত শরনার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, বে-দখল হওয়া ভূমি গুলো ফিরিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত ভূমি কমিশন কোন একটি ভূমি সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। নতুন করে বিধিমালা প্রণয়ন হয় আবার ভেস্তে যায়। সর্বশেষ ৩ অক্টোবর ২০১৬ তে গেজেট আকারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি (সংশোধন) আইন পাশ করা হয়। এবং ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬তে ৪৫ দিন সময় দিয়ে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ হতে দরখাস্ত আহ্বান করে। ৪৫ দিন সময়ের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা হতে মোট ১৪ হাজার ৮৮৫টি দরখাস্ত জমা পড়েছিল ভূমি কমিশনের কাছে। কিন্তু এতগুলো ভূমি সমস্যার একটিও ভূমি কমিশন নিষ্পত্তি করতে পারেনি। সেই থেকে আজ অবধি ভূমি কমিশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যা, সেজন্য সরকারের এই ভূমি সমস্যার সমাধান আগে করতে হবে। ভূমি সমস্যার সমাধান হলে পাহাড়ের সকল সমস্যাগুলো নিরসন করতে সহজ হবে। ভূমি সমস্যার সমাধান হলে স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মনোনীত প্রার্থীরা জেলা পরিষদ পরিচালনা করবে, এরপর আঞ্চলিক পরিষদ গঠনও সুষ্ঠু হবে। যে সময় যে দল ক্ষমতায় থাকে সে সময় তাদের দলীয় লোক দিয়ে পরিচালিত হয় এই জেলা পরিষদগুলো, যার কারণে জনগণের আশা আকাক্সক্ষাগুলো অধরাই রয়ে যায়। দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয় এই জেলা পরিষদগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চুক্তি মোতাবেক এখানকার স্থানীয় মিশ্র পুলিশবাহিনী গঠন, কিন্তু এই পুলিশ বাহিনী গঠন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য অঞ্চল থেকে চুক্তিপূর্ববর্তী যে অপারেশন উত্তরণ ছিল তা তুলে নেয়ার কথা থাকলেও আজকের বাস্তবতায় আমরা তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে লক্ষ্য করছি। পার্বত্য এলাকায় পর্যটন করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে করার কথা চুক্তিতে থাকলেও আঞ্চলিক পরিষদকে পাত্তা না দিয়েই পাহাড়ে পর্যটন ¯পট গড়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় মানুষদের মতামত নিয়ে পর্যটন করার কথা থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সকল মতামতকে উপেক্ষা করে এখানে উচ্ছেদের মত ঘৃণ্য কার্যকলাপ সংঘটিত করে পর্যটন গড়ে তোলা হচ্ছে। চুক্তির মাধ্যমে হারানো ভূমিগুলো ফিরে পাওয়ার কথা থাকলেও উল্টো চুক্তির পর জুম্মদের ভূমি বেদখলের মাত্রাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা চুক্তির পুরোপুরি লংঘন বলে আমি মনে করি।
চুক্তির পর হতেই দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে আসছে এই চুক্তি সাংবিধানিকভাবে হয়নাই। বেগম খালেদা জিয়া বলেছিল এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ফেনী-কুমিল্লা ভারতের অংশ হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ সংবিধানের ২৮ নম্বর ধারার ৪ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না”। পার্বত্য চট্টগ্রাম শতাব্দী হতে শতাব্দী ধরে অনগ্রসর এলাকা ছিল যার কারণে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আলাদা আইন করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই অনগ্রসর অংশের ভিত্তিতেই এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখানকার পাহাড়ী মানুষদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। তারপরও যদি কেউ মনে করে থাকে এই চুক্তির সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা নেই, তথাপি উচিত হবে চুক্তিটি যাতে সাংবিধানিভাবে স্বীকৃত হয় তার জন্য সংবিধানে সংশোধন আনা। জনগণের জন্যই এই সংবিধান সুতরাং জনগণের প্রয়োজনে সংবিধানে সংশোধন আনতেই হবে। অনেকে আবার বলে থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংঠনগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী। পাহাড়ের জুম্ম জনগণ বিচ্ছিন্নতাবাদী। সর্বপ্রথম আমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দাবী করেছিলাম, প্রথমে পাকিস্তান আমল এরপর বাংলাদেশ আমলেও। স্বায়ত্বশাসন দাবী সরকার না মানার ফলেই জুম্ম জনগণ কিছুটা ছাড় দিয়ে এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছুদিন আগে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরও পাহাড়ের জুম্ম জনগণকে বিচ্ছিনতাবাদী আখ্যা দিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন, আদৌতে ভিপি নুর পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে আগাগোড়া কিছু জানেন বলেও আমার মনে হয়না। এযাবত জুম্ম জনগণের পক্ষ হতে কখনো স্বাধীনতার দাবী তোলা বা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। জুম্ম জনগণ যদি কখনো স্বাধীনতার দাবী করেছে এমনটা শোনা যেতো তাহলে জুম্ম জনগণকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া যেতো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে। একদিকে পাহাড়ীদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক সংঘাত অন্যদিকে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির শেষ দাড়প্রান্তে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় লক্ষ্য কি হতে পারে এমন উত্তর খুঁজতে গেলে বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় ঐক্য ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই বলে আমি মনে করি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের একমাত্র মুক্তির সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে অতি দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ গোটা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরিতাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা করে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে সমানতালে এগিয়ে নেয়া। একথা মনে রাখা উচিত যে, দেশের এক অংশ জনগণকে পেছনে ফেলে রেখে কখনো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় দিন দিন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে পাহাড়ী জনপদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করে এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত সেটেলার প্রবেশ করিয়ে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র আজো চলমান। স্বাধীনতার সময়ে মাত্র ৮% মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল আজ ৫২% এ এসে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ী জুম্ম মানুষেরা আজ নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ইসলামি সম্প্রসারণবাদের কালো থাবায় জুম্মরা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। পাহাড়ী মানুষ আজ বিক্ষুব্ধ, চুক্তির ২৩টি বছর অতিক্রান্ত হলেও কাঙ্খিত সুফল না পাওয়ার বেদনায় বুকে জ্বলে আছে হাজারো ক্ষোভ। এই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হলে পাহাড়ে আবারো চুক্তির পূর্ববর্তী অবস্থা তৈরি হতে পারে। সুতরাং সরকারের আরো আন্তরিক হয়ে পাহাড়ী মানুষদের নিয়ে ভাবা উচিত, তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। চুক্তির দ্রুত পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।